বিশ্ব ইতিহাসে বিভিন্ন সাম্রাজ্য, রাষ্ট্র, এবং শক্তিশালী নেতাদের দখলদার বা উপনিবেশ।
বিশ্ব
ইতিহাসে বিভিন্ন সাম্রাজ্য, রাষ্ট্র, এবং
শক্তিশালী নেতারা
দখলদার
বা
উপনিবেশ স্থাপনে বড়
ভূমিকা
রেখেছেন। নিচে
কিছু
প্রধান
দখলদার
সাম্রাজ্য এবং
জাতিগুলোর উল্লেখ
করা
হলো:
১. ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল
বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য, যা
১৯
শতকের
শেষ
এবং
২০
শতকের
শুরুতে
তার
চূড়ায় পৌঁছায়। ব্রিটিশরা ভারত,
আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা এবং
এশিয়ার বিভিন্ন অংশ
দখল
করে
তাদের
সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করেছিল। উপনিবেশগুলিতে তারা
প্রশাসনিক এবং
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন
করেছিল।
২. স্প্যানিশ সাম্রাজ্য
স্প্যানিশরা ১৫
এবং
১৬
শতকে
আমেরিকা মহাদেশে বিশাল
দখলদারি গড়ে
তোলে।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অভিযানের মাধ্যমে তারা
লাতিন
আমেরিকা এবং
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে
উপনিবেশ স্থাপন
করে
এবং
স্থানীয় আদিবাসীদের উপর
শাসন
কায়েম
করে।
৩. ফরাসি সাম্রাজ্য
ফ্রান্স আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং
উত্তর
আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন
করেছিল। আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম, এবং
পশ্চিম
আফ্রিকার অনেক
দেশ
ফরাসি
দখলে
ছিল।
ফরাসি
দখলদারি সাংস্কৃতিক এবং
রাজনৈতিক প্রভাব
ফেলে
অনেক
উপনিবেশে।
৪. পর্তুগিজ সাম্রাজ্য
পর্তুগাল ১৫
শতকে
সামুদ্রিক অভিযানের মাধ্যমে ব্রাজিল, আফ্রিকা, এবং
এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন
করেছিল। তাদের
মূল
লক্ষ্য
ছিল
বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং
সমুদ্রপথের দখল।
৫. ডাচ সাম্রাজ্য
ডাচরাও
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ
আমেরিকা এবং
আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে
উপনিবেশ স্থাপন
করেছিল। ইন্দোনেশিয়া দীর্ঘদিন ডাচ
উপনিবেশ ছিল
এবং
ডাচ
ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক দখলে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন
করেছিল।
৬. রোমান সাম্রাজ্য
প্রাচীন রোমান
সাম্রাজ্য ইউরোপ,
উত্তর
আফ্রিকা, এবং
মধ্যপ্রাচ্যে তাদের
দখলদারি বিস্তার করে।
তাদের
সামরিক
শক্তি
এবং
প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে তারা
এই
বিশাল
এলাকা
শাসন
করেছিল।
৭. মঙ্গোল সাম্রাজ্য
চেঙ্গিস খান
এবং
তার
উত্তরাধিকারীরা ১৩
শতকে
বিশ্বের বৃহত্তম স্থলভাগের সাম্রাজ্য গড়ে
তোলে।
মঙ্গোল
সাম্রাজ্য এশিয়া
থেকে
পূর্ব
ইউরোপ
পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল
এবং
তাদের
সামরিক
দক্ষতা
এবং
অপ্রতিরোধ্য শাসনের
জন্য
পরিচিত
ছিল।
৮. ওসমানীয় সাম্রাজ্য
ওসমানীয়রা ১৫
শতক
থেকে
২০
শতক
পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর
আফ্রিকা, এবং
ইউরোপের একটি
বড়
অংশ
দখল
করে
রেখেছিল। তাদের
সাম্রাজ্য বিশেষত
পূর্ব
ইউরোপ
এবং
আরব
বিশ্বের ওপর
ব্যাপক
প্রভাব
ফেলে।
৯. জার্মান এবং জাপানি সাম্রাজ্য (বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়)
প্রথম
এবং
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়
জার্মানি এবং
জাপানও
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি
হিসেবে
উঠে
আসে।
জার্মানরা ইউরোপ
জুড়ে
এবং
জাপান
এশিয়া
এবং
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল
দখল
করতে
চেয়েছিল।
এসব
সাম্রাজ্য এবং
দখলদারিত্বের কার্যক্রম ইতিহাসের গভীর
প্রভাব
ফেলেছে,
যা
আধুনিক
বিশ্ব
রাজনীতি, অর্থনীতি এবং
সংস্কৃতিতে দেখা
যায়।
আধুনিক যুগে (বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর থেকে) দখলদারি বা উপনিবেশবাদ আগের
মতো সরাসরি সামরিকভাবে বিস্তৃত না হলেও কিছু
বড় শক্তি ও দেশ বিভিন্ন
পদ্ধতিতে তাদের প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এখানে
কিছু আধুনিক দখলদারি বা প্রভাব বিস্তারের
উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. রাশিয়া
আধুনিক যুগে রাশিয়া তার
প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার
এবং দখলদারীত্বের জন্য আলোচিত হয়েছে।
২০১৪ সালে, রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে, যা
আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয় এবং ইউক্রেন-রাশিয়া সম্পর্ককে আরও জটিল করে
তোলে। এছাড়াও, রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব
বজায় রাখার চেষ্টা করছে, যেমন জর্জিয়া এবং
মলদোভার কিছু অংশে।
২. চীন
চীন সামরিকভাবে দখল
না করলেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং কৌশলগতভাবে অনেক
অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছে। দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের
সামরিক স্থাপনা এবং কৃত্রিম দ্বীপ
তৈরি করে নিজেদের উপস্থিতি
বাড়াচ্ছে। তাছাড়া, চীনের "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ" (BRI) প্রকল্পের মাধ্যমে
তারা এশিয়া, আফ্রিকা, এবং ইউরোপে বিশাল
অর্থনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করছে। অনেক দেশ চীনের
কাছ থেকে ঋণ নিয়ে
পরবর্তী সময়ে কৌশলগত সুবিধা
হারাচ্ছে, যা "ঋণ দাসত্ব" হিসেবে
পরিচিত।
৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক, অর্থনৈতিক,
এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে আধুনিক যুগে প্রভাব বিস্তারকারী
একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে, এবং
তারা ন্যাটো এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক
জোটের মাধ্যমে সামরিক হস্তক্ষেপ করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য,
যেমন ইরাক এবং আফগানিস্তানে
মার্কিন সামরিক অভিযান প্রভাব বিস্তারের অন্যতম উদাহরণ। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি
এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক প্রভাব
বজায় রেখেছে।
৪. ইসরায়েল
ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি অঞ্চলে দখলদারি আধুনিক যুগের অন্যতম আলোচিত ইস্যু। বিশেষ করে পশ্চিম তীর
ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন এবং
সামরিক উপস্থিতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচিত এবং সমালোচিত। ফিলিস্তিনিরা
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের ভূমি দখল এবং
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে থাকে।
৫. সৌদি আরব ও ইরান
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও
ইরান তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক
ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের জন্য একে অপরের
সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের সামরিক
হস্তক্ষেপ এবং ইরানের হিজবুল্লাহ
এবং সিরিয়ায় তাদের সম্পৃক্ততা আঞ্চলিক দখলদারি বা প্রভাব বিস্তারের
উদাহরণ।
৬. ভারত ও পাকিস্তান
ভারত এবং পাকিস্তান
কাশ্মীর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধে লিপ্ত।
উভয় দেশই এই অঞ্চলকে
নিজেদের বলে দাবি করে
এবং কাশ্মীরের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ
করছে। এই বিরোধ থেকে
কয়েকটি যুদ্ধও হয়েছে, এবং এখনো পর্যন্ত
এই সংঘাত সম্পূর্ণরূপে সমাধান হয়নি।
৭. তুরস্ক
তুরস্কও আধুনিক যুগে আঞ্চলিক প্রভাব
বিস্তারের চেষ্টা করছে, বিশেষ করে সিরিয়া এবং
ইরাকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্কের হস্তক্ষেপ এবং কুর্দি যোদ্ধাদের
বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান তাদের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
৮. ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)
ইউরোপীয় ইউনিয়ন দখলদারি বা সামরিক প্রভাবের
মাধ্যমে নয়, বরং অর্থনৈতিক
ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার
করে থাকে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের
দেশগুলোতে তারা উন্নয়ন, ব্যবসা
এবং রাজনৈতিক সংহতির মাধ্যমে প্রভাব বাড়িয়েছে। যদিও এটি সরাসরি
দখলদারি নয়, তবে নীতিগত
ও অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার
করার একটি উদাহরণ।
৯. আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর প্রভাব
আধুনিক যুগে অনেক বহুজাতিক
কোম্পানি, বিশেষ করে খনিজ এবং
তেল সম্পদশালী দেশগুলোতে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাব
প্রায়শই স্থানীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ এবং প্রকৃতি ধ্বংসের
মাধ্যমে আসে। বিশেষত আফ্রিকা
ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ এই
ধরনের অর্থনৈতিক আধিপত্যের শিকার হয়েছে।
অতএব, আধুনিক যুগে সামরিক দখলদারি
কম হলেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক
এবং কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করে বড় শক্তিগুলো
বিভিন্ন দেশে নিজেদের আধিপত্য
বজায় রাখার চেষ্টা করছে।