শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।
সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ; কথাটা হয়তো অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য বা হাস্যকর মনে হতে
পারে। তবে, একজন শিশু শিক্ষানুরাগী হিসাবে সন্দেহাতীত ভাবে বলতে পারি যে, বাংলাদেশে
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই শিশু শিক্ষার জন্য শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান।
এখন, এ কথার সপক্ষে
কারণসমূহ জেনে নেওয়া যাক। তবে, কারণসমূহ জানার জন্য আমাদের কতিপয় প্রশ্নের উত্তর খু্ঁজতে
হবে। প্রথমে যে প্রশ্নের উত্তরটি জানা দরকার তা হল- শিশু শিক্ষার লক্ষ্য কী হওয়া উচিৎ
, অথবা শিশু শিক্ষার মাধ্যমে আমরা আবশ্যিকভাবে শিশুদের কী কী অর্জন করাতে চাই?
শিশু শিক্ষার মূল
লক্ষ্য হওয়া উচিৎ- শিশুর সার্বিক বিকাশ সাধনে সহায়তা করাসহ নিত্য প্রগতিশীল বিশ্বের
সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ভিত তৈরি করে করা; যা নিশ্চিত
করা একটি আদর্শ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর মূল কাজ।
দ্বিতীয় প্রশ্ন
হল, শিশুর সার্বিক বিকাশ বলতে আমরা কি বুঝি? এবং, তৃতীয় প্রশ্ন হল, একটি প্রতিষ্ঠানই
বা কিভাবে তা শিশুকে অর্জন করতে সহায়তা করে? এই প্রশ্ন দুটির উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে,
বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ যে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে শ্রেষ্ঠ,
তা বোঝানো সহজ হবে।
শিশুর সার্বিক
বিকাশ এবং শিশুর বিশেষ বা আংশিক বিকাশ কিন্তু এক কথা নয়। শিশুর সার্বিক বিকাশ বলতে
শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, আধ্যাত্মিক, নান্দনিক ও সৃজনশীলতার
বিকাশকে বোঝায়।
এই সকল বিকাশের
সমন্বিত রূপই হলো শিশুর সার্বিক বিকাশ। শিশুর সার্বিক বিকাশের মাধ্যমেই একটি শিশু পূর্ণাঙ্গ
মানুষ রূপে গড়ে ওঠে। এছাড়া, সময় ও প্রয়োজনীয় চাহিদার সাথে খাপ খাওয়াতে শিশুর ডিজিটাল
স্বাক্ষরতা ও বিদেশি ভাষা হিসাবে ইংরেজি শেখার শুরুটা এ স্তর থেকে যুতসই রূপে হওয়া
দরকার। আর, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ শিশুর এই সার্বিক বিকাশ
সাধনের জন্য সার্থক প্রতিষ্ঠান রূপে কাজ করে যাচ্ছে।
উপরে উল্লেখিত
তৃতীয় প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ
তাহলে শিশুর সার্বিক বিকাশ সাধনে কিভাবে ভূমিকা রাখে? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথম যে কথাটি
আসে তা হলো, প্রাথমিক শিক্ষার যুগপৎ শিক্ষাক্রম বা শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা
; যার মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব
হয়। এই শিক্ষাক্রম এত সমৃদ্ধ যে, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য একটি
মানব শিশুর যে সকল বিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রয়োজন হয় তার প্রায় সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত আছে
এ শিক্ষাক্রমে।
বাংলাদেশে সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিশুর সার্বিক বিকাশে যে ব্যবস্থা ও কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে
তা হলো- শিশুর ভাষাগত ও যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশের জন্য বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে গুরুত্বের
সাথে শিখন-শেখানো ও অনুশীলনের ব্যবস্থা, শারীরিক বিকাশের জন্য শারীরিক শিক্ষা, দৈনিক
সমাবেশ ও কাবিং কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত আছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশের জন্য গাণিতিক
ও বৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত রচনা, সামাজিক দক্ষতার বিকাশের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বপরিচয় বিষয়ের
মাধ্যমে নিজেকে জানা, পরিবারকে জানা, সমাজ-দেশ তথা বিশ্বকে জানা ও এ সংক্রান্ত দক্ষতা
অর্জনের সুযোগ, নৈতিক শিক্ষা, মানবিক উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিক বোধের বিকাশের জন্য ধর্ম
শিক্ষা, খুদে ডাক্তার, স্টুডেন্ট কাউন্সিল ও কাব-স্কাউট এর ব্যবস্থা, নান্দনিক
ও সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য শিল্পকলা বিষয়ের অধীনে চারু ও কারুকলার চর্চা, সংগীত,
নৃত্যকলা ও অভিনয় এ হাতে খড়ি ও তাদের অনুশীলনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় হলো, প্রতিযোগিতাপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য
বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাস করা মেধাবী শিক্ষক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়োগ ও
বিসিএস নন ক্যাডারের মাধ্যমে সরাসরি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ এর ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়
শিক্ষকগণের পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য এবং বিদ্যালয়ে একাডেমিক সেবা প্রদান এর লক্ষ্যে
শিক্ষকদের দোরগোড়ায় অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে অবস্থিত আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান
হিসাবে খ্যাত উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি) হতে শিক্ষকগণের বিভিন্ন বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক
প্রশিক্ষণ, প্রধান শিক্ষকের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ, প্রাক-প্রাথমিক এর শ্রেণির
শিক্ষকগণের প্রশিক্ষণ, একীভূত শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, শিক্ষাক্রম বিস্তরণ বিষয়ক
প্রশিক্ষণ ও নব যোগদানকৃত শিক্ষকগণের জন্য ইনডাকশন প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ প্রশিক্ষণের
ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া জেলা পর্যায়ে, পিটিআই থেকে মৌলিক প্রশিক্ষণ হিসাবে পরিমার্জিত
ডিপিএড (বিটিপিটি) ও আইসিটি ইন এডুকেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত,
দক্ষ ও পেশাদার শিক্ষকগণের মাধ্যমে সকল শ্রেণি পেশার অভিভাবকগণের সন্তানদের একীভূত
পরিবেশে মিলেমিশে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ। আইসিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্ট
ব্যবহার করে পাঠদান এবং আলো-বাতাস পূর্ণ খোলামেলা ও প্রশস্ত শ্রেণিকক্ষে সাধারণ বিষয়সমূহ
পাঠদানের ব্যবস্থা।
তাছাড়া, শিশুদের
বয়স, মেধা, ধারণ ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার স্তর বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষায় শ্রেণিভেদে
রচিত মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক, প্রয়োগ উপযোগী শিখন শেখানো সামগ্রী, বিদ্যালয় পর্যায়ে
উন্নয়ন পরিকল্পনা (স্লিপ) এর আওতায় শিক্ষা উপকরণ ক্রয় এর ব্যবস্থা, আকর্ষণীয় ও
দৃষ্টিনন্দন শ্রেণীকক্ষ এবং শিশুতোষ উপকরণ ও শিখন সামগ্রী সমৃদ্ধ প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির
জন্য প্রতিবছর শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের জন্য বিশেষ বরাদ্দ, শতভাগ শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি
প্রদানের ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি- ৪ এর আওতায় আধুনিক স্কুল ভবন
নির্মাণ এর ব্যবস্থা, পুরাতন ও জরাজীর্ণ স্কুল ভবন মেরামতের জন্য ক্ষুদ্র মেরামত খাতে
বরাদ্দ প্রদান এর মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ভবন সংস্কার, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী দপ্তরের মাধ্যমে
উন্নতমানের ওয়াসব্লক নির্মাণ এর ব্যবস্থা।
বিদ্যালয়ের সামনে
বড় খেলার মাঠে খেলাধুলার সুযোগ, বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী, ভারসম্য ও দোলনার ব্যবস্থা,
ডিজিটাল সেবার আওতায় ইউনিক আইডি এর ব্যবস্থা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার
সুযোগ, কমিউনিটি পর্যায়ে বা অভিভাবকগণের সাথে নিয়মিত ও নিবিড় যোগাযোগের জন্য মা সমাবেশ,
অভিভাবক সমাবেশ, হোম ভিজিট ও উঠান বৈঠক এর আয়োজন, আরো আছে বিদ্যালয় পর্যায়ে এসএমসি,
পিটিএ ও স্লিপ কমিটির উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রদান, উপজেলা বা মাঠ পর্যায়
হতে উপজেলা রিসাের্স সেন্টার ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এর কর্মকর্তাগনের নিয়মিত
সরজমিনে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও তদারকির ব্যবস্থা, বিদ্যালয় পরিদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষকের
পেশাগত মান উন্নয়নসহ বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশের উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা, এছাড়া
জেলা, বিভাগ ও অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিয়মিত যোগাযোগ ও তদারকির
ব্যবস্থা, সবিশেষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিশুদের বিনা বেতনে শিক্ষা গ্রহণের
সুযোগ, তার মধ্যে অন্যতম। শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে আর কোন প্রতিষ্ঠানে শিশুর সার্বিক
বিকাশের জন্য এমন যথার্থ, মানসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত সুযোগ-সুবিধা ও সেবার জুড়ি মেলা
ভার। সারাদেশের প্রেক্ষিতে অল্পকিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়লেও, দ্বিধাহীন ভাবে বলাই যায়
যে, শিশু শিক্ষার জন্য বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই সেরা প্রতিষ্ঠান।
তবে উল্লেখ্য যে,
২০২১ সালের প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম
চালু করার পর মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের শিক্ষক ও অভিভাবক পর্যায়ে সমালোচনা ও অসন্তুষ্টির
ঝড় উঠলেও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম নিয়ে তেমন কোন সমালোচনা বা অসন্তুষ্টি তৈরি
হয়নি। তবে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের
মধ্যে কিছুটা দ্বিধা ও অস্পষ্টতা দেখা দেয়। যার প্রেক্ষিতে, ধারাবাহিক মূল্যায়নের
অংশ হিসাবে বিগত সরকার শিক্ষক ডায়েরী-১ ও শিক্ষক ডায়েরি-২ এর কার্যক্রম স্থগিত করে।
সে প্রেক্ষিতে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক
বোর্ড (এনসিটিবি) ২০২১ সালের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আওতায় মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে
নতুনভাবে কাজ শুরু করে ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তবে, বর্তমান
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক ও অভিভাবকগণের অসন্তুষ্টি
ও সমালোচনার প্রেক্ষিতে এবং বর্তমান সরকারের সংস্কার কাজের অংশ হিসাবে ২০২১ সালের পরিমার্জিত
শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন বর্তমান বছরের শেষ সময় পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে আগামী,
২০২৫ সাল থেকে স্থগিত এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বর্তমান সরকার থেকে এমন ঘোষণাও
দেওয়া হয় যে, ২০২৫ সাল থেকে পূর্বের অর্থাৎ ২০১১ সালের শিক্ষাক্রম মোতাবেক শ্রেণি কার্যক্রম
পরিচালিত হবে। তবে, ২০১১ বা ২০২১ যে সালের শিক্ষাক্রম অনুসারেই শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন
করা হোক না কেন, অথবা ২০২১ সালের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের যোজন-বিয়োজন
করা হোক না কেন; বরাবরের মতো বাংলাদেশের শিশু শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণের সুচিন্তিত পরামর্শ
ও সুপারিশ মোতাবেকই তা করা হবে। যাতে শিশুর সার্বিক বিকাশ সাধন করাসহ প্রগতিশীল বিশ্বের
সাথে তাল মিলিয়ে; বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে সক্ষম হয়
আমাদের শিশুরা এবং বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ভিত তৈরি হয় তা নিশ্চিত করা
হবে, সে প্রত্যাশা। আর সেটা করা হলে, শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ই যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক-