ঈষৎ বাদামী চোখের ছেলেটাকে লেখা অলিখিত চিঠি। কবরী বিশ্বাস অপু

 ঈষৎ বাদামী চোখের ছেলেটাকে লেখা অলিখিত চিঠি।



ঈষৎ বাদামী চোখ,

তোমাকে লেখা শেষ চিঠিটি পোস্ট করে আসলাম আজ।খামের উপরে তোমার নাম লিখতে আমার আঙুল যতটা কেঁপে উঠলো তারচেয়ে বেশি কেঁপে গেল বুকের মধ্যে! হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল! সেটা তুলে কাঁপা হাতে তোমার নাম লিখতে আমার চোখ থেকে কয়েকটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো, তোমার নামের অক্ষর গেল বেঁকে!

আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে চিঠিটি পোস্ট করে তাড়াহুড়ো করে পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম! তারপর আমি একা হেঁটে যাচ্ছি উদ্দেশ্যহীন। যদিও নিজেকে ভীষণ নির্ভার লাগছে। কতদিন পরে নিজেকে ওজনহীন মনে হচ্ছে। কতদিন যেন এই চিঠির অক্ষরগুলো পাহাড়সম ওজন নিয়ে আমার বুকের মধ্যে  চেপে ছিল।

পোস্ট করার পরে মাথাটা ভীষণ হাল্কা লাগছে।

এই প্রথম অনুভব করলাম, অক্ষরেরও এত ওজন হতে পারে! এমন দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে। শব্দেরা এতটা বিদ্ধ করতে পারে!

এসব ভাবতে ভাবতে আমি বেশ খানিকটা হেঁটে এসেছি। আমি খুব ঘামছি। ঘামের সাথে চোখের জল মিলিয়ে যাচ্ছে। পা থেমে আসছে এখন। আমি নিজেকে শুধচ্ছি যে,জানতে চাইবনা, এই চিঠি পৌঁছলো কিনা,তুমি তা পড়েছ কিনা,ইত্যাদি!

তারই ফাঁকে মনে মনে উচ্চারণ করছি আমার পছন্দের লাইন দুটি,

"বড় হয়ে যাচ্ছি, বড় হচ্ছে শোক

তবু দেখানো যাবেনা ভেজা দুটি চোখ।"

 এই শহরে আমি নতুন। তেমন কিছুই চিনিনা। অদূরে একটা ছোট্ট ক্যাফে দেখা যাচ্ছে। তখন গোধূলির আলো চকচকে করছে। আমার ভয়ংকর খিদেও পেয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে আমি ঘেমে গলে যাচ্ছি। ক্যাফেতে ঢুকে কোল্ড কফি খেয়ে ফেললাম এক চুমুকে। অথচ ভুলেই গিয়েছিলাম আমার টনসিল বেড়ে গেছে 'দিন ধরেই!

 বেরিয়ে একটা রিকশা ডাকলাম। ড্রাইভার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,কোথায় যাবেন?

আমি বললাম শহর ঘুরব। চলেন। উনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রিকশার গতি বাড়ালেন। আজকাল রিকশায় উঠেই আমি আনমনা হয়ে যাই।

তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছে। তোমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে না পারাটা কষ্ট দিচ্ছে, অভিমানে গাল ফুলিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে!

চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, এই অনাদর ভাল্লাগে না।

বলতে ইচ্ছে করছে, আমার চেয়ে গুরুত্ববহ এই পৃথিবীতে কেউ নেই,কিচ্ছু নেই!

রিকশা দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। ক্রমশ দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে আমাদের। এতদিনের কয়েকশো মাইল দূরত্ব আজ কয়েকককোটি গুণ বেড়ে গেছে।

আমার আর ফেরা হবেনা কোনদিন। নিজেকে কথা দিয়েছি,অনাহুত হয়ে কোথাও থাকবনা আর!

সন্ধ্যা নেমে এসেছে।আমি ক্লান্ত পায়ে ফিরে আসছি বাসার দিকে।

তখন কানে হেডফোন গুঁজে আকাশ পানে তাকিয়ে  শুনছি-

নির্ঝর গগনে, অপলক চেয়ে রই
বিস্মৃত কবিতা, আনকা পবনে-
মেঘলা কবেকার স্মৃতিময় বাতায়ন
বলে যায়তোমায় অনব ভালবাসি
 দিপীকা সায়রে
অনিমেষ চেয়ে রই
মিথিলা বরষা, অলোক দহনে-
মেঘলা কবেকার স্মৃতিময় বাতায়ন
বলে যায়তোমায় অনব ভালবাসি

 রিকশা এসে থামলো। ভাড়া দিয়ে আমি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি রুমের দিকে, যেখানে আমার নিজস্ব একটা পৃথিবী আছে। অনুপম অপুময় সে পৃথিবী। সেখানে কেবল প্রবেশিধাকার আমারই।

 ____চিরঅভিমানিনী ~গ্রীষ্মের সেই মেয়েটা।


কবরী বিশ্বাস অপু
ভাস্কর
পিটিআই ইন্সট্রাক্টর (চারু কারুকলা
পিটিআইখুলনা।

2 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post

হেলথ টিপস