কাঁধ ছুঁইছুঁই চুলের ছেলেটাকে লেখা অলিখিত চিঠি।
চাকুরীজীবনে
চতুর্থবার বদলি হয়ে যে
কর্মস্থলে যোগদান করলাম,ঘটনাক্রমে ঈষৎ বাদামী চোখও
যোগদান করল আমি যোগদান
করার ঠিক পরের দিন।
এই শহর আমাদের দুজনের কাছেই অচেনা। সেদিন সকালে অফিসের বড় আয়নার সামনে
দাঁড়িয়ে আমি শাড়ির কুচি
আর তীব্র গরমে চোখের লেপ্টে
যাওয়া কাজল ঠিক করছিলাম।
এমন সময় ৬ ফুট ১
ইঞ্চি লম্বা উচ্চতার কাঁধ ছুঁইছুঁই চুলের
ছেলেটা অফিসে ঢুকল। আমি ইতস্ততভাবে ঘাড় ফিরিয়ে তার
দিকে তাকাতেই যেন থ হয়ে
গেলাম।
এটা
কি সত্যি,নাকি কল্পনা, নাকি
স্বপ্ন কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম
না। নিজেকে ওজনহীন মনে হলো যেন!
খানিক
বাদে সম্বিত ফিরে পেলাম। সম্বিত ফিরে
এলেও আমি যেন কোথায়
তলিয়ে গেছি।সে অতল থেকে নিজেকে
কোনোভাবেই টেনে তোলা যাচ্ছে
না। শেষবার সার্জারি শেষে মানে আমার
বা পাশের স্তন টিউমারটা সার্জারির
পরে ওটি থেকে বেরিয়ে
যখন আমার জ্ঞান ফিরছিলো,
আধো জ্ঞানহীন আমি যেন শূন্যে
ভাসছিলাম, আমার খানিকটা সেরকম
মনে হচ্ছে!
এতদিন
যাকে আমি কয়েকশো মাইল
দূরত্বে বসে ভালোবেসেছি, যার
নামে এত কাব্য করেছি,
বানোয়াট গল্প লিখেছি, পাঠকদের
কৌতুহলী করে রেখেছি, কখনো
কখনো পাঠকদের বোকা বানিয়েছি, ভুল
ভেবে কত ফেসবুকীয় বন্ধুর
সম্পর্কও ভেঙে গেছে!
যে আমাকে লক্ষ যোজন দূরত্ব
ছাপিয়ে না ছুঁয়েও রোজ
ছুঁয়ে গেছে, সে কিনা আমার
সামনে? তাকে আমি আমার
চোখ দিয়ে দেখছি?
আমরা
স্বল্প দূরত্বে পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছি। অফিসে সে
আর আমি ব্যতীত কেউ
নেই। কোনো কথাই যেন আমার
মুখে আসছেনা। অব্যক্ত কথারা ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা জাগাচ্ছে ক্রমাগত। অথচ তার সাথে দেখা
করার জন্য, কথা বলার জন্য
ভীষণ ব্যাকুলতায় আমি কাটিয়ে দিয়েছি
কত বর্ষা,বসন্ত। দেখা হলে তার সাথে
এক শতাব্দীর কথা বলবো ভেবেছি
প্রতিদিন। তার জন্য গেঁথেছি কথার
মালা। কখনো কখনো কথারা জমে
জমে অভিমান হয়ে গেছে। অভিমানের
পাহাড় জমিয়েছি কত! সেসব কোথায়
যে হারিয়ে গেল!
অথচ,যার সাথে দেখা
করার জন্য, কথা বলার জন্য
আমি কী ব্যাকুল প্রতীক্ষায়
থেকেছি।দেখা হবার আনন্দে কত
পরিকল্পনা করেছি দশক ধরে।সেসব কথারা
কোথায় উবে গেল?
দুটি
অচেনা -অজানা মানুষের মধ্যে কীভাবে হৃদয়ের আদান-প্রদান হয়ে
যায়, কীভাবে অদেখা কারো হৃদয়ে স্থায়ী
আবাসভূমি গড়ে ওঠে?
আর,
প্রতিটি চিরকুটের সম্বোধনে লেখা থাকে, "চিরঅভিমানিনী
''।কারণ এই নামটা ঈষৎ
বাদামী চোখেরই দেওয়া।
এমনি
করেই অনিন্দ্য সব সকাল শুরু
হতে লাগলো। দিনের শুরুটা স্পেশাল হতে লাগলো। নান্দনিক হয়ে
উঠলো যেন জীবন যাপন
। অফিসের অপ্রশস্ত বকুল আর হিজল
শোভিত ওয়াকওয়ে ধরে আমরা দুজনে
পাশাপাশি হেঁটে একসাথে অফিসে আসা-যাওয়া করি।
আমি তার পায়ের সঙ্গে পা মেলাই,সে
হয়তো টের পায়না,অথবা
পায়। সেসব অবশ্য ভাবায়না। সে টের পেলেও আনন্দ,
না পেলেও আনন্দ জাগে । একসঙ্গে কফি,আড্ডা,খুনসুটিতে দিনগুলো কেটে যায়। আমরা নানান
ছুতোয় আঙুলে আঙুল ছুঁই। কফির চুমুকে
আমি তার দিকে নির্বাক
চেয়ে থাকি। তার চোখ কত কথা
বলে যায়। একজীবনে যত
কথা তাকে বলব ভেবে
শতাব্দীসম কথামালা জমিয়েছিলাম। তার সাথে দেখা হবার
পরেই আমার সমস্ত কথা
হারিয়ে গেল যেন!আমি
এত চুপচাপ হয়ে গেলাম কেমন
করে সে ঘোর কাটেনা
আমার! তবু দিনের রেশ
থেকে যায় সকাল থেকে
মধ্য রাত কিংবা তারও
অধিক!
এমন
করেই আমরা নতুন এক
প্রেমের উপাখ্যান শুরু করে ফেললাম
কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই।এমন করেই বোধহয় প্রেম
হয়ে যায়?
এখন আমি তার
পাশে চুপ করে বসে
আছি।
সে প্রেমময় অলিখিত
এক গল্প বলে চলেছে.....
আমি বক্তা থেকে
কখন যেন মুগ্ধ শ্রোতা
হয়ে উঠলাম!
কর্ণকুহরে তার শব্দচয়ন শ্রুতিমধুরতায়
আচ্ছন্ন করে রাখছে....
___চিরঅভিমানিনী ~গ্রীষ্মের সেই মেয়েটা।