ঈষৎ বাদামী চোখের ছেলেটা । কবরী বিশ্বাস অপু

  ঈষৎ বাদামী চোখের ছেলেটা



ঈষৎ বাদামী চোখের দেয়া শাড়িটা পরে আজ সকালে অফিসে এসেছি।অফিস শেষ করে তার সাথে শেষবারের মতো দেখা হবে।অফিসে আজ অনেক কাজ।কিন্তু কোনোকিছুই আমাকে ভাবাচ্ছেনা।

এই শহরে তার প্রথমবার আসা এবং হয়তো শেষবারও।

সে আসবে অথচ আমার কোনো উত্তেজনা নেই।এত শান্ত-স্নিগ্ধ আমাকে এর আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা।

অথচ তাকে ভেবেই আমার আনন্দে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা,দিনের পর দিন।আমি আনন্দে তিড়িংবিড়িং করে বেড়াতাম ঘর থেকে সে ঘর।আমার পথচলাকে আরও রোমাঞ্চিত করত সে।তার আসার উত্তেজনায় ঘটে যেত কত অঘটনও!অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো তাকে ভেবে।এমন সুখকর অনুভূতি আর হয়না।সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করাও যায় না।

সেসবও আমার মনে কোনো দাগ কাটছেনা।নির্বিকার এবং ভীষণ পরিপাটি লাগছে নিজেকে।

 কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, দেখা হলে তাকে আমি কী বলবো?এতদিনের জমানো যে অভিমান,তা কী আমার দুচোখ ছাপিয়ে গলে পড়বে?

আবার নিজেকে বুঝাচ্ছি,চোখ ভেজানো যাবেনা কোনভাবেই। তাকে দেখানো যাবেনা ভেজা চোখ।আজ তার কাছে নিজেকে ভীষণ বড় প্রমাণ করতে ইচ্ছে করছে যেন বড়দের মতো পরিনত আচরণ করতে পারি!অথচ তার চুল পাকা দেখতে দেখতে আমার বড় হবার কথা ছিল!

 আবার ভাবছি,যদিও দুচোখ ভরে ওঠে জলে,

সে কী সামনে থেকে আমার পাশে এসে বসবে?আমার হাত দুটো কি শক্ত করে ধরবে?আমাকে কি বাহুডোরে আগলে নেবে?মুছে দেবে কি চোখ?আমার কি তাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে?তার আঙুলে আঙুল রাখতে ইচ্ছে করবে?ইচ্ছে করবে কি সজোরে জড়িয়ে ধরতে? আমার অনেক কথা কি বলতে ইচ্ছে করবে? নাকি একটি শব্দও উচ্চারিত হবেনা?

এসব ভাবছি আর অফিসের কাজ সেরে নিচ্ছি। এত স্বাভাবিক কেন লাগছে আমাকে?

 আমি জয়েন করেছি দেড়মাস হয়েছে।

চাকরি প্রাপ্তির এই সাফল্যটুকুও তাকে জানানো হয়নি অভিমানে!তাকে বলা হয়নি,  না বলা কথারা জমে জমে পাহাড় হয়েছে সেই কবেই।সে পাহাড় ডিঙানোর ক্ষমতা বা ইচ্ছে আমার আর নেই।আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি বিচ্ছেদের।বলা হয়নি বুকের মধ্যে দুমড়েমুচড়ে গেছে কতবার তোমাকে মিস করে!

 এই শহরে একা লাগে খুব, নতুন লাগে সবকিছু ।ছিমছাম আটপৌরে শহর।অচেনা রাস্তাঘাট, অচেনা মানুষজন আমি দুচোখ ভরে দেখি।একা বিকেলে রিক্সায় চড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে।বাতাসে মিশে যায় ভাবনারা।আমি তলিয়ে যাই কোথায় যেন!সেখান থেকে বাস্তবে ফিরতে ইচ্ছে করেনা।সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি।

গত এক যুগে আমাদের অগুনিত সুখস্মৃতি জমা হয়েছে।প্রথম দেখার আগে থেকেও জমিয়েছি অসংখ্য সুখকর মুহূর্ত। সেসব চোখের সামনে ঝলমল করে উঠছে। নস্টালজিকও হচ্ছি।হচ্ছি ভারাক্রান্ত!এখন বিষন্ন লাগছে খুব!

 বৃষ্টি নামলে আমি তাকে ভীষণ মিস করি।জানালার বাইরে দুহাত বাড়িয়ে বৃষ্টিজল ছুঁতে দারুণ প্রশান্তি জাগে।মন ভালো হয়ে যায় সহসা।ঈষৎ বাদামী চোখ হচ্ছে আমার সেই মিশ্র অনুভূতি যাকে আমি অতি আনন্দে মিস করি,অতি দুঃখেও।খুব ভোরে ঘুম ভেঙে স্নান সেরে যখন কফিতে চুমুক দিই,আমি তার ভাবনাতে তলিয়ে যাই।ইচ্ছে করে খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিই।কিন্তু আমি জানি,আমি তার কেউ নইতবুওপ্রতিদিন শাড়ি পরার সময়,অফিসে যাবার সময় কিংবা অফিস থেকে ফেরার সময় তাকে মনে পড়ে।তবু তাকে বলা হয়না কতকাল! সেও জানে তাকে আমি হৃদয়ভরে মিস করি।আমার কান্না পায় রাতদুপুরে তাকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙে গেলে!

সেও কি আমাকে ভাবে?তার স্বপ্নে আমি আসিতাকে ছুঁয়ে যাই আগের মতোন?

 ঈষৎ বাদামী চোখের সাথে যোগাযোগ ছিলনা নয়মাস।বিচ্ছেদের মতো ভীষণ সত্যি বিষয়টিকে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল।তারওবেশি কষ্ট দিয়েছিল তার অনাদর!এতবার যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি আমরা যে,বিচ্ছেদের সংজ্ঞাও বদলে গেছে আমাদের।

যদিও এসব কোনোকিছুই আর ভাবার সুযোগ নেই।চূড়ান্ত বিচ্ছেদটা হয়ে যাবে আজই।দেখা হবার পরে যে যার মতো চলে যাব!তাকে আমি ফেসবুক থেকে ব্লক করে দেব,ব্লক করে দেব ইমেইলও।আমার ফেইক আইডিটাও ডিলিট করে দেব।কারণ,আমি লুকিয়েও তাকে দেখবোনা আর!আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে শিখেছি অনেক আগেই।

আসলে,"অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মত বিড়ম্বনা আর হয় না

 এই কথা অবশ্য সে জানেনা।গতকয়েক মাসে আমরা দুর্দান্ত অভিনয় করেছি ভালোবাসার,কাছে থাকার।কেমন করে তার সাথে ছলনার খেলাতেও জিতে গেলাম,জিতে গেলাম অভিমানের খেলাতেও!পিচ্চিটা থেকে পরিনত হয়ে গেলাম যেন!

 আজ আমিই তাকে আসতে বলেছি।কারণ, আমাদের যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে।রোজ বলে বলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায় না।যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয় না বলেই,এমন ছল করেই।

 কিন্তু, কী সে কারণ,সেকথা অজানাই থাক.........

 শুধুস্যুভিনির হিসেবে আমি রেখে দিয়েছি তার একটা টিশার্ট!

 ___চিরঅভিমানিনী ~গ্রীষ্মের সেই মেয়েটা।


কবরী বিশ্বাস অপু
ইন্সট্রাক্টর(চারু ও কারুকলা)
পিটিআই, খুলনা

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

হেলথ টিপস