শিশু শিক্ষার ধরণ, উদ্দেশ্য ও গুরুত্বের বিষয়টি শিক্ষিত ও সমাজের সচেতন
মহলের কাছে খুব একটা অজানা না হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কমিউনিটি পর্যায়ের অভিভাবক
তথা জনসাধারণের মধ্যে এ সংক্রান্ত ধরণা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে এখনো যে বিস্তর ঘাটতি রয়েছে
তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইংরেজ উপনিবেশ আমল থেকে চালু হওয়া মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা
ব্যবস্থা এবং শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়ার যে ধারণা ও প্রবনতা তা আজও সমাজের সাধারণ মানুষের মন
ও মননে স্থায়ীরূপে শিঁকড় গেড়ে বসে আছে। এ ব্যবস্থায়, এক শিশুর সাথে তার শ্রেণির অন্য
শিশুদের অর্জিত শিখন ও মেধার মধ্যে তুলনাকরণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার নামে শিশুতে শিশুতে
আনুষ্ঠানিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টির সংস্কৃতি চালু রয়েছে।
তবে, শিশু শিক্ষা ভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণার সুপারিশ ও সময়ের পরিবর্তনে
শিশু শিক্ষার ধরন চাহিদা, পদ্ধতি ও কৌশল ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে পরিবর্তিত
হয়েছে এবং এই মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর শিখন শেখানো কার্যক্রম ও শিখনে শিশুতে শিশুতে প্রতিযোগিতার
যে মনোভাব ও ব্যবস্থা সময়ের বিবর্তনে অনেকটাই অকার্যকর ও শিক্ষা বিজ্ঞান পরিপন্থী
উপায় হিসাবে পরিগণিত হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। অথচ, আমরা আজও এই অকার্যকর শিক্ষা চেতনার
বোঝা বয়ে চলেছি। ইতোমধ্যে, ২০২৩ সাল থেকে ১ম শ্রেণীতে নতুন পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম
২০২১ এর আলোকে মুখস্থ বিদ্যার নির্ভরতা কমিয়ে শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, কর্মভিত্তিক
এবং অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পদ্ধতি ও কৌশলের মাধ্যমে শিখন শেখানো ও মূল্যায়ন কার্যের বাস্তবায়ন
শুরু করা হয়েছে। তবে, সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার এই পরিবর্তিত ধরণা ও ব্যবস্থার
বিষয়ে এখনো ব্যাপকহারে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। কারণ, শ্রেণিকক্ষ কেন্দ্রীক
কাগজ-কলম নির্ভর আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শ্রেণিতে প্রতিটি শিশুর প্রথম
হওয়া বা মেধার ভিত্তিতে রোল নম্বর ১ হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বীতার
বীজ যুগ যুগ ধরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রথিত হয়ে শক্তপোক্ত রূপ ধারণ করেছে; যদিও আধুনিক শিখন মতবাদের নিরিখে আজ তা শিক্ষার
অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, একটি শ্রেণির সহপাঠীদের
মধ্যে শিখন শেখানো ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শিশুদের মধ্যে তুলনাকরণের মাধ্যমে এই যে নেতিবাচক প্রতিযোগিতা,
তা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।


আমরা জানি যে, পৃথিবীর প্রতিটি শিশুই আলাদা। তেমনি, প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের কোন একটি শ্রেণিতে যতজন শিক্ষার্থী থাকে তাদের প্রত্যেকই আলাদা। প্রতিটি
শিশুর এই আলাদা হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে।
ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশগত অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক সচেতনতা, স্বাস্থ্য
সচেতনতা, পুষ্টিকর খাবার, শিশুর শৈশবকালীন
বিকাশের উপযোগী যত্ন, স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, পারিবারে আচার-আচরণের চর্চা, সর্বপরি
পারিবারিক শিক্ষা ও সচেতনতা প্রভৃতির ভিন্নতার কারণে শিশুরা একে অন্যের থেকে ভিন্ন।
এছাড়া মাতৃগর্ভকালীন শিশুর যত্ন এবং জন্মগতভাবে প্রাপ্ত জেনেটিক বৈশিষ্ট্য , বিশেষ
গুণাবলী ও বুদ্ধিমত্তার কারণেও থাকে শিশুদের মাঝে বৈচিত্রতা ও ভিন্নতা।সব মিলিয়ে,
প্রতিটি শিশুই ভিন্ন সত্তার অধিকারী।
প্রতিটি শিশুই যেখানে ভিন্ন সত্তা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী, সেখানে
শিশুর শিখন চাহিদা, আগ্রহ, পছন্দ, সামর্থ্য ও বুদ্ধিমত্তাও ভিন্ন। বিধায়, এক শিশুর
সাথে অন্য শিশুর মেধা ও বুদ্ধিমত্তার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে শিখনের অবস্থান
নির্ণয় ও মান নির্ধারণ করে জনসমক্ষে আয়োজন করে ফলাফল প্রকাশ করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত
বা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, উন্নত দেশগুলোতে যদি কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর
শিখন অর্জনের প্রেক্ষিতে গ্রেট প্রদান করা হয়, তা গোপন রাখা হয় এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী
ও তার অভিভাবক জানতে পারে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না। যে যুক্তিতে জনসমক্ষে ফলাফল
প্রকাশ করা হয় না তা হলো, তা শিক্ষার্থীর মনোসামাজিকভাবে প্রভাবিক করে শিশুর স্বাভাবিক
বিকাশকে বাধা প্রশ্ন করতে পারে।
আমরা জানি যে, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও কম সচেতন পরিবারের শিশুদের
বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতির হার । তাদের কেউ কেউ আবার বিদ্যালয়ের পাশাপাশি শিশুশ্রমে
লিপ্ত হয় পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য। বিভিন্ন কারণে তাদের অনেকেই বিদ্যালয়
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিনের পূর্ণসময় শ্রমে ব্যয় করে এবং শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন
হয় বা ঝরে পড়ে। আর যারা অনিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে আসে, তারা শিখনে পিছিয়ে পড়ে। পরিবারের
অভিভাবকদের আর্থিক অভাব ও অসচেতনতা ঐ সকল শিশুর শিক্ষা গ্রহণের প্রধান প্রতিবন্ধকতা
হিসেবে দেখা দেয়। অনিয়মিতভাবে উপস্থিতি ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে
আনা এবং নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিদ্যালয় পর্যায়ে হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক, মা
সমাবেশ ও অভিভাবক সমাবেশ এর ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কার্যকরভাবে
বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যার কারণে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নিয়মিত
বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং শিখন দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা
গ্রহণ, তথা ঝরে পড়া রোধ করার যে কার্যক্রম
তা প্রত্যাশিত মাত্রায় ও মানে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে, সকলের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক
শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
শুধু সামাজিক পর্যায়ে নয়, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যক্তিবর্গের কাছেও
প্রচলিত এই মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর শিখন-শেখানো কার্যক্রম ও কাগজ-কলম নির্ভর সামষ্টিক
মূল্যায়নের বাইরে আধুনিক ধ্যান-ধারণা এখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। শিক্ষার্থীর শিখনের পারগতার নিরিখে
ক্রমভিত্তিক (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়..…) অবস্থান
নির্ধারণ ও শ্রেণি রোল নম্বর প্রদান করার বিধান থেকে বের হতে হয়তো আরো কিছু সময় লাগবে।
প্রচলিত মূল্যায়ন অবস্থা শিশুদের শিখনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব
ফেলে তা নিন্মরুপে প্রকাশ করা যায়-
উদাহরণস্বরূপ, ৪০ জন শিক্ষার্থী বিশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
কোনো একটি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন অর্জন বা পারগতার তুলনামূলক বিশ্লেষণের
নিরিখে অবস্থান নির্ধারণ করে ফলাফল
প্রকাশের মাধ্যমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীদের
বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করা হয় এবং পাশাপাশি অবশিষ্ট শিক্ষার্থীদেরকে (সংখ্যা অনুসারে
চতুর্থ থেকে সর্বশেষ স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীদেরকে) তাদের তুলনামূলক কম শিখন অর্জনের
প্রেক্ষিতে কোন প্রকারে পুরস্কৃত না করে বরং নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলাফল প্রকাশ ও পুরস্কার
বিতরণী অনুষ্ঠানে তারা কেবল দর্শক ও হাততালি প্রদানকারী সাধারণ জনগণের অংশভুক্ত হয়। শিখনে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের সাথে পিছিয়ে পড়া
শিক্ষার্থীদের সামাজিক পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথক করা হয়। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে
পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এটা বোঝানো হয় যে তোমরা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী এবং তোমাদের
দ্বারা জীবনে বা ভবিষ্যতে আর ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। এতে করে, শ্রেণির অধিকাংশ শিক্ষার্থী
তার আত্মবিশ্বাস ও আগ্রহ হারিয়ে (পিছিয়ে পড়া
শিক্ষার্থীরা) শিখনে দিনকে দিন আরো পিছিয়ে পড়ে এবং ঐ সমস্ত শিক্ষার্থীর মা-বাবা তথা
অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে, শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া
শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায় এবং তাদের অধিকাংশ একসময় ঝড়ে পড়ে।
অপরদিকে, পারিবারিক বিভিন্ন সুবিধার কারণে যারা শিখন অর্জন ও
পারগতায় এগিয়ে থাকে এবং আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয় ; তারা
মানসিকভাবে সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স এ ভোগে। যা ঐ শিশুর সাবলিল বিকাশের জন্য বাঁধা হয়ে
দাঁড়ায়। এতে, একটি শ্রেণির সহপাঠীদের মধ্যে মনোভাব ও আচরণে পার্থক্য তৈরি করে। শিক্ষার্থীদের
মধ্যে এমন মানসিক বৈষম্যের সৃষ্টি করা শিখন শেখানো ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা মানসম্মত প্রাথমিক
শিক্ষা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা যেহেতু তাদের পরিবার ও পরিবারের
আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। শিশুর শিখনে অপারগতা বা পিছিয়ে পড়ার জন্য তার
প্রতিকূল পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জসমূহ চরমভাবে দায়ী। শিশু নিজে কোনভাবে দায়ী নয়। অপরদিকে,
যে শিশু নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে, পারিবারিক সহযোগিতা, পুষ্টিকর খাবার ও শিখনের জন্য
অনুকূল পরিবেশ পায়, তার পারগতা ও শিখনে এগিয়ে
থাকার জন্য এই সমস্ত সুবিধাসমূহ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এই পারগতার সকল কৃতিত্ব ওই শিক্ষার্থীর
নয় বরং তার পরিবারিক সুযোগ সুবিধার । শিখনে এগিয়ে থাকা বা ভালো ফলাফলের প্রেক্ষিতে
কোনো শিশুকে পুরস্কৃত করা হলে প্রকারান্তরে তা মূলত তার পরিবার ও অভিভাবকদেরকেই করা
হয়। তাই, এক শিশুর শিখনের সাথে অন্য শিশুর শিখনের তুলনা করে অর্জিত শিখনের মান যাচাই
করা কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। শিশুর শিখন অর্জন যাচাই এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শিশুর নিজের
সাথে নিজের তুলনা করা চলে। শিশু শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- শিশুর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা
ও
বৈচিত্র্যময় চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে তার জীবন ও জীবিকার জন্য
সক্ষম করে তোলা। এক শিশুর শিখন অর্জনের সাথে অন্য শিশুর শিখন অর্জনের তুলনাকরণের সে
উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
অবশ্য, পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এর বাস্তবায়ন শুরু
হয়েছে চলমান ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম শ্রেণিতে। অন্যান্য শ্রেণিগুলোতে
পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ২০২5 সাল থকে প্রাথমিক শিক্ষার সকল শ্রেণিতে এই নতুন শিক্ষাক্রম পরিপূর্ণভাবে
বাস্তবায়ন শুরু হবে।
নতুন এই শিক্ষাক্রমের দার্শনিক ভিত্তি হলো -গঠনবাদ। এই গঠনবাদ
এর মূল উপাদান হলো সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বা ভাষা। শিশুরা এই সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বা
ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে একে অপরের সাথে মিলেমিশে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ও সহযোগিতামূলক শিখন
কৌশলের প্রয়োগ করে কোনো ধারনার গঠন ও পুণগঠনের মাধ্যমে নতুন কোনো ধারণা বা জ্ঞান অর্জন
করতে সক্ষম হয়। যার ফলে শিশুরা তাদের জীবন ও জীবিকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিখনের মৌলিক
চাহিদা পূরণের পূর্ণ সুযোগ পায় ।
যেখানে শিশুদের সমাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও সহযোগিতামূলক
শিখন কৌশলের মাধ্যমে নতুন ধারণা বা শিখন অর্জনের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, সেখানে
শিখনের নামে শিশুদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি
সৃষ্টির যে ঝুঁকি রয়েছে সে শিখন-শেখানো ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা আর কোনোভাবেই অনুসরণযোগ্য
হতে পারে না।
ইতোমধ্যে, এই নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট
জনবলদের অবহিতকরণ, সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম ব্যাপক ভাবে শুরু করা
হয়েছে। কিন্ত, বাকী রয়ে গেল সাধারণ জনগণ, যাদের শিশু সন্তানদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার
এই মহা আয়োজন। নতুন এই শিক্ষাক্রমের শিখন-শেখানো ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত পরিবর্তিত
ও নতুন ধারণা বিষয়ে জনসাধারণকে এখনো অবহিত করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
প্রথম শ্রেণীতে ২০২৩ সাল থেকে বাস্তবায়িত হওয়ার প্রেক্ষিতে নতুন কারিকুলাম বা শিখন-শেখানো
ও মূল্যায়ন বিষয়ে জনমনে কিছুটা বিভ্রান্ত সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে আনুষ্ঠানিকভাবে
নেওয়া সামষ্টিক মূল্যায়ন; তথা সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা না থাকা এবং তার প্রেক্ষিতে
শিক্ষার্থীদের শিখন অর্জন মূল্যায়নের মাধ্যমে রোল নম্বর না পাওয়া বা প্রথম, দ্বিতীয়
ও তৃতীয়... হওয়ার সুযোগ না থাকায় জনমনে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কিছুটা হতাশা ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে ; যার সরাসরি নেতিবাচক
প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে শিক্ষার্থীর ভর্তি, নিয়মিত উপস্থিতি, বিদ্যালয়ের শিখন শেখানো
কাজে। শিক্ষাক্রম বিষয়ে জনগণের এহেন বিভ্রান্তি অনতিবিলম্বে দূর না করা গেলে, নতুন
কারিকুলামের বাস্তবায়ন বাঁধাগ্রস্থ হতে পারে।
এখন জরুরী কাজ হলো, আধুনিক ও যুগপোযোগী এই শিক্ষাক্রম সংশ্লিষ্ট
সকল ক্ষেত্রে যথাযথ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা। আর, এ কাজটি করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষার
দক্ষ জনবল তথা, শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্তৃক সক্রিয় তত্ত্বাবধান ও প্রচেষ্টার পাশাপাশি
নিয়মিতভাবে বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এলাকায় কার্যকর হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক, মা সমাবেশ, অভিভাবক
সমাবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ সভার মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তিত ধারণা,
আধুনিক ও বহুমুখী শিখন শেখানা কৌশল ও নমনীয় মূল্যায়ন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা প্রদান,
সচেতনতা সৃষ্টি এবং উদ্বুদ্ধকরণ সভার আয়োজন করা খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। অভিভাবক ও জনসাধারণকে
এটা বোঝানো জরুরী যে একটি শ্রেণির শুধুমাত্র এক, দুই বা তিনজন শিক্ষার্থীকে নয় বরং
সকল শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সামর্থ, বুদ্ধিমত্তা ও সুযোগকে পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে
শিখনের সর্বচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়
পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারে। যদি তা করা যায়, তাহলে বিদ্যালয় কমিউনিটি এলাকার
অভিভাবকসহ জনসাধারণ শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের এ মহতি ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ সম্পর্কে অবগত
হবে, শিশু শিক্ষা ও শিশুর শিখনের কাঙ্খিত মূল্যায়ন কৌশলসমূহ সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে
এবং নতুন শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সমাজের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। যার প্রেক্ষিতে, অল্প সময়ের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার
বর্তমানের অন্যতম একটি বাঁধা অর্থাৎ, শিশুর আধুনিক শিখন শেখানো কৌশল ও নমনীয় মূল্যায়ন
ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারণা বা অস্পষ্টতা দূরীভূত হবে। যার ফলে, মানসম্মত প্রাথমিক
শিক্ষা নিশ্চিতকরণের পথে তরতর করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক:
মোঃ রুহুল আমিন
ইন্সট্রাক্টর
উপজেলা রিসোর্স
সেন্টার
ফুলতলা,
খুলনা।