ডাক্তারদের জন্য আয়কর পরামর্শ! আব্দুল্লাহ আল নোমান, কর-পরিদর্শক

ডাক্তারদের জন্য আয়কর পরামর্শ!


একজন ট্যাক্সম্যান হিসেবে আমি আজ আপনারা যাঁরা ডাক্তার তাঁদের জন্য আয়কর বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেবো; যা মেনে চললে আশা করি, আয়কর নিয়ে আপনাদেরকে আর ঝামেলা বা জটিলতায় পড়তে হবে না।

জটিলতা বা ঝামেলা কী কী হয়ে থাকে সেটা আগে বলি।

প্রথমত, আপনারা অনেকেই আয়কর কীভাবে হিসাব করতে হয় সেটা জানেন না। ফলে, আয়কর আইনজীবীদের দারস্থ হন।
দ্বিতীয়ত, আপনার আয়কর নথি আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তদন্তের জন্য নির্বাচিত হতে পারে।

প্রথম সমস্যাটার ব্যাপারে আমি বেশি কিছু বলব না। শুধু এটুকু পরামর্শ দিতে চাই, আপনি যেন আপনার আইনজীবীর কাছ থেকে পাই পাই করে হিসাব বুঝে নেন। আপনার বেতন আয়ের পাশাপাশি পেশাগত আয় হিসেবে কত আয় প্রদর্শন করা হলো তা আপনাকে জানতে হবে। আইনজীবী যে আয়কর রিটার্ন জমা দেবেন, সেই রিটার্নে নিজের স্বাক্ষর ও সিল দেবেন এবং রিটার্নের ফটোকপি অবশ্যই আপনার কাছে রাখবেন। রিটার্নের সাথে যে সকল ডকুমেন্ট জমা দেবেন, সেগুলোর একসেট ফটোকপিও আপনার ফাইলে রাখবেন। আর কেউ যদি নিজেই রিটার্ন পূরণ করে জমা দেন, সেক্ষেত্রেও ওপরের কাজগুলো করতে হবে। মোটকথা, আয়কর অফিসের অনুরূপ একটি ফাইল আপনার নিজের কাছেও সংরক্ষণ করতে হবে।

এখন আপনার আয়কর নথি অডিটের জন্য নির্বাচিত হলে কী করবেন?

এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ; আপনার আয়ের সপক্ষে যদি প্রমাণাদি থাকে তবে তা সংযুক্ত করে লিখিতভাবে উত্তর দেবেন। কিন্তু সমস্যা হলো- আপনারা বেশিরভাগই কোনো প্রমাণাদি সংরক্ষণ করেন না। কীভাবে আপনার আয়ের সপক্ষে প্রমাণাদি সংরক্ষণ করবেন সেটিই মূলত আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য।

আপনাদের বেতন আয়ের সপক্ষে প্রমাণাদি নিয়ে সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না। কারণ বেতন আয় সুনির্দিষ্ট এবং সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট দ্বারা সমর্থিত হয়ে থাকে। সমস্যা হয় মূলত পেশাগত আয় নিয়ে। এক্ষেত্রে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, আপনার আয়ের সপক্ষে প্রমাণাদি দাখিলের দায়িত্ব আপনারই। আপনি যখনই তা করতে ব্যর্থ হবেন তখন আয়কর কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট আইনিক বিধান অনুসারে আপনার আয় পুনরায় নির্ধারণ করবেন। এই পুনর্নির্ধারিত আয় আপনার প্রকৃত আয় থেকে বেশি যেমন হতে পারে, তেমনি তা কমও হতে পারে।

তাহলে, আপনার করণীয় হলো- আপনার পেশাগত আয়ের হিসাব রাখা এবং তা সংরক্ষণ করা। আপনি যদি চেম্বারে রোগী দেখেন তাহলে একটি রেজিস্টার খাতা সংরক্ষণ করুন। রেজিস্টার খাতায় যেদিন রোগী দেখবেন সেদিনের তারিখ দিয়ে ক্রমিক নম্বর, রোগীর নাম, রোগীর মোবাইল নম্বর, রোগী নতুন না পুরনো, রোগের বিবরণ, পরামর্শ ফি, রোগীর স্বাক্ষর প্রভৃতি তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মনে রাখবেন, রোগীর মোবাইল নম্বর অবশ্যই দিতে হবে; কারণ এই রোগী হলেন আপনার সাক্ষী। কর পরিদর্শক যখন আপনার অডিট মামলাটি তদন্ত করবেন, তখন আপনার তথ্যের সঠিকতা তিনি এর মাধ্যমে সহজেই যাচাই করতে পারবেন।

এখন ধরুন, আপনি সপ্তাহে ০৫ দিন রোগী দেখেন। এই ০৫ দিনের কোনো একদিন যদি রোগী না দেখেন সেক্ষেত্রে আপনি রেজিস্টারে ঐ দিন রোগী না দেখার কারণ উল্লেখ করে দিন। আবার, অনেক সময় আপনি কোনো রোগীর কাছ থেকে পরামর্শ ফি নাও নিতে পারেন; সেটাও রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করুন। মোটকথা, আপনাকে সুস্পষ্ট হিসাব রাখতে হবে।

আপনি যদি কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে অপারেশন করেন তাহলে সেই ক্লিনিক থেকে অবশ্যই ফি প্রাপ্তির জন্য রশিদ নিয়ে নেবেন এবং তা সংরক্ষণ করবেন। এক্ষেত্রে ক্লিনিকের দায়িত্ব হলো আপনাকে উৎসে কর কর্তন করে ফি পরিশোধ করা; যা তারা অনেক ক্ষেত্রেই করে থাকে না। অথচ, উৎসে কর কর্তন করে রাখলে আপনারই সুবিধা। বেতন থেকে যেমন প্রতি মাসে আপনি আয়কর কেটে রাখেন, বিষয়টা তেমনই। রিটার্ন দাখিলের সময় কেবল আপনাকে উৎসে করের সপক্ষে সংশ্লিষ্ট ক্লিনিক থেকে চালানসহ প্রত্যয়ন নিতে হবে।

আপনার পেশাগত খাতে প্রাপ্তির বিপরীতে সাধারণত তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩ অংশ) খরচ দাবি করতে পারবেন।

অর্থাৎ, আপনি যদি রোগী দেখে বছরে ১২ লাখ টাকা পরামর্শ ফি প্রাপ্ত হন তবে আপনি খরচ হিসেবে পাবেন ০৪ লাখ টাকা; বাকি ০৮ লাখ টাকা হবে আপনার নিট আয়। তবে, আপনার যদি ১/৩ অংশের চেয়ে বেশি খরচ হয়, তবে তার জন্য আপনাকে অবশ্যই হিসাবের খাতাপত্র সংরক্ষণ করতে হবে এবং তা সংশ্লিষ্ট ভাউচার বা ডকুমেন্ট দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। মনে রাখবেন, এখানে খরচ বলতে রোগী দেখার সাথে সংশ্লিষ্ট সাধারণ খরচাদিকে বোঝায়। যেমন- চেম্বারের ভাড়া, পিএ বা এসিস্ট্যান্টের বেতন, চেম্বারের বিদ্যুত বিল প্রভৃতি।

লেখাটি আর বড়ো করব না। আমি যে বিষয়টি বলতে চেয়েছি আশা করি, তা নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে। আমার অল্প সময়ের চাকরির অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ ব্যাপারে আপনারা উদাসীন এবং মোটেও সচেতন নন। আমি ডাক্তারদের আয়কর মামলার এ পর্যন্ত যে কয়টি তদন্ত করেছি কোনোটির ক্ষেত্রেই সচেতন কাউকে পাইনি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। মনে রাখবেন, সচেতনতাই পারে আয়কর সম্পর্কিত সকল জটিলতা থেকে আপনাকে মুক্ত রাখতে। শুধু আপনার আয়ের ক্ষেত্রেই নয়; যেকোনো বিনিয়োগও সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। অর্থাৎ, আপনি জমি বা বাড়ি বা গাড়ি কিনলেন; তার প্রমাণাদি আপনাকে অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। পারিবারিক ব্যয় প্রদর্শনের সময় তা খাতওয়ারি উল্লেখ করবেন।

আপনাদের জন্য শেষ পরামর্শটি হলো- আপনার পেশাগত আয়ের সকল ডকুমেন্ট পিছনে অন্তত ০৬ বছরের জন্য সংরক্ষণ করবেন; কারণ পিছনের ০৬ বছর পর্যন্ত আপনার আয়কর নথিটি পুনরায় উন্মোচিত হতে পারে।

লেখাটি শেষ করছি, করোনাকালে রোগীর সেবায় নিয়োজিত ডাক্তারদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের ঋণও শোধ হবার নয়।

পাঠকদের প্রতি আবেদন, দয়া করে ডাক্তারদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করবেন না। তার চেয়ে আসুন, আমরা সময়ের কষ্টিপাথরে নিজেদেরকেই মূল্যায়িত করি।

আব্দুল্লাহ আল নোমান কর-পরিদর্শক, নাটোর।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

হেলথ টিপস