রেওয়াজ, শাহেদ আহমদ

রেওয়াজ




অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে। রাতের শেষ প্রহর হইতে সেই যে রিমঝিম বৃষ্টির মৃত্তিকার সাথে মিতালী পাতিবার গভীর খায়েশ তাহা যেন আখের গোছায় না এখনও। চৈত্রের খড়দগ্ধ বিচলিত হাজারো উৎসুক প্রাণ এক ফোঁটা বারির পরম ছোঁয়ায় আপনকার প্রাণ শীতল করিবার জন্য চাহিয়া থাকিতো আকাশের দিকে মুখ করিয়াঃ সেই সব উষর প্রাণও যেন উর্বর, উর্বর নয় অতিমাত্রায় উর্বর;  তাইতো ছন্দতোলা বৃষ্টির নিরন্তর অধোগমন হৃদয়কে উদ্বেলিত করেনা – এর থেকে মুক্তি পাইলে যেন বাঁচে।

এক হাঁটু পঙ্ক মাড়াইয়া, ছাতা মাথায় লইয়া দুই বন্ধু ছুটিলাম। জাবেদ এবং আমি। আমার বন্ধু নতুন মোবাইল সেট কিনিবে বলিয়া তাহার অনুরোধ প্রত্যাখান করিতে পারিলাম না। পথের দুর্যোগ মনকে পঙ্গু করিতে পারিল না। মোবাইল প্রাপ্তির আনন্দে তাহা কর্পূর হইয়া উড়িয়া গেল।

গাঁয়ের শেষ মাথায় শহরে যাইবার যেই গাড়ি ষ্ট্যান্ড, বর্ষার বিভীষিকা উপেক্ষা করিয়া সেইখানে যখন পৌছিলাম – বেলা তখন নয়টা। দীঘির পানিতে কর্দম ধৌত করিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিলাম। গল্প করিতে লাগিলাম। মোবাইল কিনিতে যাইতেছি, গল্পটা তাই মোবাইল নিয়া হইবে – ইহাই স্বাভাবিক। কথার ফাঁকে ফাঁকে একটি দোকানের বারান্দায় দাঁড়ানো একজন মহিলার দিকে নিবিষ্ট হইল। বোরকা পরিহিতা এক মহিলাকে দেখে মনে হইল বড় অসহায় আর পরিশান। তাঁহার সর্বাঙ্গ জুড়িয়া দারিদ্র আর দুঃখ অস্পষ্ট ভঙ্গিতে কিলবিল করিতেছে।

হঠাৎ আসিয়া ঐ মহিলাটি আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াইল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলিল,‘বাবারা! আমি বড় বিফদে ফরছি রেবা। আমার লগে খয়টা খাটল। খত খরিয়া ডাইবাররে খইলাম আমারে বিনা ভাড়ায় নিতে, রাজি অইল না। বড়লেখা ফর্যন্ত গেলেগি বাড়ি যাইতাম ফারমু্।“ বলিয়া আশ্বস্থ উত্তরের জন্য ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল। আশ্বাস দেওয়া মাত্র ঐ মহিলা তড়িৎগতিতে কাঁঠালগুলো গাড়িতে তুলিয়া আমাদের নিকটবর্তী সীটে বসিলেন।

কিছু জিজ্ঞাসা করিবার আগেই বলিতে লাগিলেন, বাবাগো আল্লায় তোমরার ভালা খরবো। বিয়ানে মেঘর মাঝে আইছি। এখনও কুন্তা মুখো ফড়ছে না। বড় ফুরিটারে খয়েখদিন আগে বিয়া দিছি।
আম-খাট্‌লির ছিজন। মেয়ের বাড়িত আম খাট্‌লি না দিলে বদনাম অইব। পুরির বাড় থাকি খবর আইছে আম-খাটলি না দিলে জামাইর বাড়ির হখলে হুনাই হুনাই খতা খয়। মেয়ের হরি খোটা দে আম-খাট্‌লি না দিতে ফারলে পুরি বিয়া দিবার দরখার কিতা! বাবাগো, আমি গরিব মানুষ। টাখা খই ফাইমু? তাই তোমাতানর গাওত আইলাম। মাইনষর বাড়ি থাকি কুজিয়া খাটল খয়টা যোগাড় খরলাম। ইগুলো মেয়ের বাড়ি ফাটাইমু।

মহিলার কথা শেষ হইল। চাহিয়া দেখিলাম তাহার কালিমাখা চোখযুগল আর্দ্র হইয়া উঠিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনাকে কষ্ট করিতে হইল। আপনার স্বামী কোথায়?
মহিলা বলিলেন, দুই বছর আগে তাইন মারা গেছইন। তাই হখল কিছু আমারে দেখ্‌তে অয়। বাবা! দুই ফুয়া আর দুই ফুরি লইয়া বড় খষ্টে দিন খাট্‌তেছি। বড় ফুরিরে বিয়া দিলে কিতা অইবো| এখনও আমি লাগাইয়া ছাইর ফেটর হিসাব খরতে অয়।

বলিলাম, আপনার চলে কেমন করিয়া?
মহিলা বলিলেন, বাবাগো আমার দশ বছরের ফুয়ায় খংকিট ভাঙ্গে। যা ফায় তাই দিয়া আম্‌রার ছলে কোন লাখান। যেদিন খামো যায় এদিন খাই, না গেলে উফাস্ থাকি। দুই দিন ধরিয়া ফুয়াটার আমার তাফ্। খামো যাইতে ফারের না। আমরাও না খাইয়া আছি।’

মহিলার চেহারার দিকে ভালো করিয়া চাহিলাম। দেখিলাম, চোঁখ-মুখ শুকাইয়া ত্বক কেমন যেন খস্‌খসে হইয়া উঠিয়াছে। অনাহারী মানুষের ছাপ তাহার সমস্ত চেহারা আর কথার মধ্যে পরিস্ফুট। বলিলাম, এই অবস্থায় কেন আম-কাঠ্‌লি দিতে গেলেন?

মহিলা বলিলেন, সখ করিতো আর দিয়ার না বাবা। ফুরির আমার মুখ বাঁচাইতে অইবো না ?’

বলিলাম, মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোক কি আপনার অবস্থা জানে না?

মহিলা বলিলেন, জানে বাবা! হখলতাও জানে।


মহিলাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলাম না। আরো আলাপ করিয়া এই উপবাসী নারীর শক্তি ক্ষয় করিতে বিবেক বাঁধা দিল। এমনিতেই সময়ে সময়ে মহিলার কথা আড়ষ্ট হইতেছে। চাহিয়া দেখিলাম আমার বন্ধুও নির্বাক। নিথর কন্ঠখানি তাহার কথা বলিবার ভাষা হারাইয়া ফেলিয়াছে। গাড়ির জানালার দিকে তাকাইয়া রহিলাম। বাহ্যত রাস্তার দুইধারের পত্র পল্লবের দিকে চাহিতেছি; কিন্তু না, আমার মন চলিয়া গেল পাঁচ ছয় বছর গত হওয়া অতীতের পানে। স্মরণ হইল এমনি করিয়া আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া মেয়ের বাড়িতে আম-কাঠ্‌লি দিবেন। হাতে তাহার টাকা নাই। শেষ পর্যন্ত তিনি আম্‌মার দ্বারস্থ হইলেন। আম্মা তাহাকে কিছু টাকা দিয়া সাহায্য করিলে তিনি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হইয়াছিলেন সেদিন। রাজ্য বিজয় করিয়া সেনাপতি যেমন তৃপ্তির হাসি হাসিতে পারে, আমার মনে হইল সেদিনের সেই দীপ্তিময় মুখখানি যেন আরো অধিক তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিয়াছিল। সেদিনের সেই ঘটনা অন্তরে কোন দাগ কাটিল না সত্য, কিন্তু আজ তাহা হৃদয় ‍দিয়া অনুভব করিলাম।

ভাবিতে লাগিলাম, সমাজের এ কেমন খামখেয়ালিতা! এ কেমন রেওয়াজ যাহা মানুষের সহনীয়তাকে পিষ্ঠ করিয়া তাহার বুকের উপর বসায় লৌকিকতার পেরেগ। মানুষের ভাবখানা এমন – ফরজের মত ইহা না আদায় করিলে নয়।

ইহা এমন এক নির্দয় কালচারঃ বিত্তশালীর বিলাসিতার পসরা হইতে যাহার জন্ম; নিরত দংশন করিতেছে সমাজের পরতে পরতে। ইহা এমন এক বাঙ্গালী ট্র্যাডিশন যাহা সমাজকে গিলিয়া ফেলিয়াছে পুরোপুরি। তাহার গ্রাস হইতে বাহির হইবার পথ রুদ্ধ। যাহারা বাস করে আকাশচুম্বী অট্টালিকায়, যাহাদের ভোজনের গন্ধে সুবাসিত হইয়া উঠে বাতাস – তাহাদের কাছে এই ট্র্যাডিশন সুখকর হইতে পারে; কিন্তু ভাত জুটিলে যাহাদের পাতে সালুন জুটে না, আধিক্যতা নয় ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তার জন্য যাহারা সংগ্রাম করে অনন্তর – তাহাদের কাছে ইহা কোন আনন্দের বিষয় নয়, স্রেফ উপদ্রব।

ইহা এমন এক সামাজিকতাঃ ধনীর জন্য শীতল সান্নিধ্য, গরীবের জন্য নির্মম পেষণ। ধনীর জন্য যাহা নিতান্ত উৎসব, গরীবের জন্য তাহা লঙ্কা বিজয়। পেট পুরিলে যাহাদের পিঠ খালি থাকে তাহারাও যেহেতু সমাজের বাসিন্দা; অতিএব সমাজের অলঙ্গনীয়(?) নিয়মকে উপেক্ষা করিবার উপায় নাই। তাইতো সমাজের নিষ্ঠুর চাপ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য একজন বিধবা ক্ষুধার কষ্ট লইয়া, বৃষ্টির দুর্ভোগ উপেক্ষা করিয়া, আত্মসম্মান ভুলিয়া মানুষের দ্বারে হাত পাতিতে পারেন, অন্য আর একজন কর্জ করিতে দ্বিধা করেন না।

ধিক্কার হে সমাজ! তোমার বুকে বিত্তবানরা করে রসের খেলা। বিত্তহীনরা শরীরের চামড়া বিক্রি করিয়া শোধ করে বিত্তবানদের খেয়ালীতার খেসারত।

গাড়ি আসিয়া স্টপোজ থামিল। গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। অতঃপর রিক্সা ডাকিয়া ঐ মহিলাকে বাড়িতে যাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিলাম। আমাদের প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিয়া তিনি চলিয়া গেলেন। আমার বন্ধু একটিই মাত্র কথা বলিল, ঐ সব দুঃখীদের জন্য নিজেকে হাতেম তাই হওয়া চাই। কিন্তু তাহা কী করিয়া সম্ভব!


লেখক: শাহেদ আহমদ,ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ)

প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনসস্টিটিউট সুনামগঞ্জ
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

হেলথ টিপস