ডায়াবেটিসের আদ্যপান্ত
ডায়াবেটিস শব্দটি আমাদের সবার কাছেই বেশ পরিচিত। এমন পরিবার খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে ,যেখানে কোনো ডায়াবেটিসের রোগী নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ। এই রোগের অত্যধিক বিস্তারের কারণেই সম্প্রতি এমন ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রশ্ন আসতেই পারে, ডায়াবেটিস কী?
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
আমরা যখন কোন খাবার খাই তখন আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে চিনিতে (গ্লুকোজ) রুপান্তরিত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের যে হরমোন নিসৃত হয়, সেটা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ দেয় চিনিকে গ্রহণ করার জন্যে। এই চিনি কাজ করে শরীরের জ্বালানী বা শক্তি হিসেবে।শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি হতে না পারে অথবা এটা ঠিক মতো কাজ না করে তখনই ডায়াবেটিস হয়। এবং এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনি জমা হতে শুরু করে এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদঃ
ডায়াবেটিস মূলত দুই ধরনের হয়। টাইপ ১ ও টাইপ ২ ।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তের প্রবাহে গ্লুকোজ জমা হতে শুরু করে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস ধরা পড়ে শৈশবেই। বিজ্ঞানীরা এখনও বের করতে পারেন নি কী কারণে এরকমটা হয়।
তবে তারা বিশ্বাস করেন যে এর পেছনে জিনগত কারণ থাকতে পারে। অথবা অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও এমন হতে পারে।যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ৫ থেকে ১০ শতাংশ এই টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত।
অন্যটি টাইপ ২ ডায়াবেটিসঃ এই ধরনের ডায়াবেটিসে যারা আক্রান্ত তাদের অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না অথবা এই হরমোনটি ঠিক মতো কাজ করে না।
সাধারণত মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ ব্যক্তিরা টাইপ ২ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি এবং যাদেরকে বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তাদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ এই টাইপ ২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত।
এছাড়াও তৃতীয় আরেক ধরণের ডায়াবেটিস দেখা যায়, সেটা হল গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস। তাদের দেহ থেকে যখন নিজের এবং সন্তানের জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন যথেষ্ট পরিমানে তৈরি হতে না পারে, তখনই তাদের ডায়াবেটিস হতে পারে। মায়ের শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়মিত মাপা তাই খুব জরুরী। সাধারণত সন্তান জন্মের পরে মা সুস্থ হয়ে যায়, তবে তারপরেও তার ঝুঁকি রয়ে যায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসের।
এক গবেষণায় দেখা গেছে ৬ থেকে ১৬ শতাংশ গর্ভবতী নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়েট, শরীর চর্চ্চা অথবা ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে তাদের শরীরে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেলে তাদের টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
এক গবেষণায় দেখা গেছে ৬ থেকে ১৬ শতাংশ গর্ভবতী নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়েট, শরীর চর্চ্চা অথবা ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে তাদের শরীরে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেলে তাদের টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
শফিকুল ইসলাম
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো
‘টাইপ-১ ডায়াবেটিসে’-এর কিছু লক্ষণ-
• অবসাদ, পিপাসা বৃদ্ধি পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, বমি বমি ভাব হওয়া, বমি হওয়া, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া।
‘টাইপ-১ ডায়াবেটিস’ রোগীদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে থাকে এবং জরুরী অবস্থার মধ্য দিয়ে এটি নির্ণীত হয়।
‘টাইপ-২ ডায়াবেটিসে’-এর কিছু লক্ষণ-
• ঝাপসা বা অস্পষ্ট দৃষ্টি, অবসাদ, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া, পিপাসা বৃদ্ধি পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
*যেহেতু টাইপ-২ ডায়াবেটিস ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, তাই কিছু কিছু ব্যক্তির রক্তে উচ্চ মাত্রায় গ্লুকোজ থাকা সত্ত্বেও তারা এই লক্ষণগুলো আদৌ বুঝতে পারেনা।
‘টাইপ-২ ডায়াবেটিস’ -হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে-
১। বয়স ৪৫ বছরের বেশী হলে,
২। পিতামাতার কোন একজন, ভাই অথবা বোন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে,
৩। গর্ভধারনকালীন ডায়াবেটিস হলে অথবা ৯ পাউন্ড অপেক্ষাবেশী ওজনের বচ্চা প্রসব করলে,
৪। হৃদরোগ থাকলে,
৫। রক্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল বা চর্বি থাকলে,
৬। অতিশয় স্থুলতা থাকলে,
৭। পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করলে,
৮। মহিলাদের পলিসিস্টিক ওভারি ডিসিজ অর্থাৎ ডিম্বাশয়ে টিউমার হলে,
৯। রক্ত পরীক্ষায় গ্লুকোজ বা শর্করার সহনশীলতা জনিত বৈকল্য (IGT) থাকলে,
১০। কোন কোন বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী জনগোষ্ঠি।
ডায়াবেটিসের কারণে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?
* রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
* শরীরে যদি রক্ত ঠিক মতো প্রবাহিত হতে না পারে, যেসব জায়গায় রক্তের প্রয়োজন সেখানে যদি এই রক্ত পৌঁছাতে না পারে, তখন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
* এর ফলে মানুষ দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারে। ইনফেকশন হতে পারে পায়ে।
* বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির পেছনে একটি বড় কারণ ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস নির্ণয় করার পরীক্ষাঃ
• প্রাথমিকভাবে প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে তাতে গ্লুকোজ বা শর্করা এবং চর্বি ভেঙ্গে যাওয়ায় সৃষ্ট কিটোন বডির উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। তবে ডায়াবেটিস সনাক্তকরণের জন্য প্রস্রাব পরীক্ষার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা উচিত নয়।
ডায়াবেটিস সনাক্তকরণের জন্য রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করা নির্ণয়ের কিছু পরীক্ষা ও মাত্রা-
• অভুক্ত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা (FBS) -> যদি পর পর দু’বার ১২৬ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ৭.০মিলি.মোল/এল বা তা অপেক্ষা বেশী হয় তবে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এই মাত্রা ১০০ থেকে ১২৫ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ৫.৬ থেকে ৬.৯ মিলি. মোল/এল পর্যন্ত হলে তাকে (IFG- impaired fasting glucose) উপবাসকালীন হানিকর শর্করা অর্থাৎ ডায়াবেটিস হওয়ার পূর্ব-অবস্থা হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
এই মাত্রাগুলোকে ধরন-২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার বিপদ সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২। পিতামাতার কোন একজন, ভাই অথবা বোন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে,
৩। গর্ভধারনকালীন ডায়াবেটিস হলে অথবা ৯ পাউন্ড অপেক্ষাবেশী ওজনের বচ্চা প্রসব করলে,
৪। হৃদরোগ থাকলে,
৫। রক্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল বা চর্বি থাকলে,
৬। অতিশয় স্থুলতা থাকলে,
৭। পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করলে,
৮। মহিলাদের পলিসিস্টিক ওভারি ডিসিজ অর্থাৎ ডিম্বাশয়ে টিউমার হলে,
৯। রক্ত পরীক্ষায় গ্লুকোজ বা শর্করার সহনশীলতা জনিত বৈকল্য (IGT) থাকলে,
১০। কোন কোন বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী জনগোষ্ঠি।
ডায়াবেটিসের কারণে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?
* রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
* শরীরে যদি রক্ত ঠিক মতো প্রবাহিত হতে না পারে, যেসব জায়গায় রক্তের প্রয়োজন সেখানে যদি এই রক্ত পৌঁছাতে না পারে, তখন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
* এর ফলে মানুষ দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারে। ইনফেকশন হতে পারে পায়ে।
* বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির পেছনে একটি বড় কারণ ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস নির্ণয় করার পরীক্ষাঃ
• প্রাথমিকভাবে প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে তাতে গ্লুকোজ বা শর্করা এবং চর্বি ভেঙ্গে যাওয়ায় সৃষ্ট কিটোন বডির উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। তবে ডায়াবেটিস সনাক্তকরণের জন্য প্রস্রাব পরীক্ষার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা উচিত নয়।
ডায়াবেটিস সনাক্তকরণের জন্য রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করা নির্ণয়ের কিছু পরীক্ষা ও মাত্রা-
• অভুক্ত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা (FBS) -> যদি পর পর দু’বার ১২৬ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ৭.০মিলি.মোল/এল বা তা অপেক্ষা বেশী হয় তবে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এই মাত্রা ১০০ থেকে ১২৫ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ৫.৬ থেকে ৬.৯ মিলি. মোল/এল পর্যন্ত হলে তাকে (IFG- impaired fasting glucose) উপবাসকালীন হানিকর শর্করা অর্থাৎ ডায়াবেটিস হওয়ার পূর্ব-অবস্থা হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
এই মাত্রাগুলোকে ধরন-২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার বিপদ সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
• মুখে খাওয়া গ্লুকোজের সহনশীলতা পরীক্ষা (GTT) -> মুখে (৭৫ গ্রাম) গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘন্টা পর রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা ২০০ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ১১.১মিলি. মোল/এল বা তা অপেক্ষা বেশী হলে তাকে ডায়াবেটিস ধরা হয়।
এই পরীক্ষা ‘ধরন-২ ডায়বেটিস’ সনাক্ত করার জন্য বেশী ব্যবহৃত হয়। এই মাত্রা ১৪০ মিলিগ্রাম/ডি.এল থেকে ১৯৯ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ৭.৮ থেকে ১১ মিলি. মোল/এল পর্যন্ত হলে এই অবস্থাকে Impaired glucose tolerance (IGT) হিসেবে ধরা হয়
এবং যা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ইংগিত বহন করে।
• ভুক্ত অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা (RBS)-> ২০০মিলিগ্রাম/ডি.এল বা ১১.১মিলি.মোল/এল বা তা অপেক্ষা বেশী হলে এবং সেই সঙ্গে ডায়াবেটিসের উপসর্গ যেমন অতিরিক্ত পিপাসা, ঘন ঘন প্রস্রাব, অবসাদ ইত্যাদি থাকলে ডায়াবেটিস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোগ সনাক্তকরণের পরবর্তী ধাপ হিসেবে 'মুখে খাওয়া গ্লুকোজের সহনশীলতা পরীক্ষা' অর্থাৎ (GTT)অবশ্যই করে নিতে হবে।
• উপরের পরীক্ষাগুলো ছাড়াও প্রতি ৩-৬ মাসের মধ্যে অন্তত একবার হিমগ্লোবিনের A1c (HbA1c) পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এই HbA1c নিরূপণের মাধ্যমে পূর্বের ২-৩ মাস সময়ের মধ্যে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কেমন ছিল তা অনুমান করা যায়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার ফলাফল বোঝার জন্য যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারো A1c এর মাত্রা ৫ পর্যন্ত স্বাভাবিক ধরা হয়। ৫.৭ থেকে ৬.৪ পর্যন্ত হলে তাকে ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হবার জন্য ঝুকিপূর্ণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
আর ৬.৫ বা তা অপেক্ষা বেশি হলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বলে ধরে নেয়া হয়।
ডায়াবেটিস কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
ডায়াবেটিসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হলো এই রোগ কখনো পুরোপুরি ভালো হয় না।তবে কিছু উপায় রয়েছে যা আগে থেকে পালন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ লেখায় রয়েছে ডায়াবেটিস সচেতনতার তেমন কিছু উপায়।
১। চিনিযুক্ত খাবার এবং পরিশোধিত শর্করা খাওয়া বাদ দিন। ধবধবে সাদা আটা-ময়দা বাদ দিয়ে লাল আটার তৈরি রুটি ও অন্যান্য খাবার খান। এটি আপনার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাবে।
২। শারীরিক অনুশীলন করুন। আপনি যদি নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন করেন তাহলে তা নানাভাবে আপনার স্বাস্থ্যের উপকার করবে। বিশেষ করে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন রোগ দূরে রাখায় এর ভূমিকা রয়েছে। এতে ডায়াবেটিসের মতো রোগও দূরে থাকবে।
৩। মিষ্টি পানীয় বাদ দিন। তেষ্টা পেলেই মিষ্টি পানীয় বা কোমল পানীয় পান করার অভ্যাস বাদ দিন। প্রচুর পানি পান করুন। মূলত যে কোনো মিষ্টি পানীয়ই ক্ষতিকর। তাই এসব পানীয় সম্পূর্ণ ত্যাগ করুন।
৪। ওজন কমান। শরীরের ওজন যদি বেশি বেড়ে যায় তাহলে তা ডায়াবেটিসকে ডেকে আনতে পারে। তাই দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫। ধূমপান বর্জন করুন। ধূমপানে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এর কারণ হলো দেহের হরমোনজনিত পরিবর্তন। এ কারণে ডায়াবেটিস থেকে দূরে থাকতে ধূমপান বর্জন করা উচিত।
৬। খাবারের পরিমাণ কমান। মাত্রাতিরিক্ত খাবার খাওয়া ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ। এ কারণে খাবারের পরিমাণ কমানো উচিত আগেভাগেই। খাবার খাওয়া কমানোর জন্য ছোট ছোট প্লেটে অল্প করে খাবার নিতে পারেন।
এছাড়া খাবার খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেও তাতে খাবারের পরিমাণ কমতে পারে।
৭। আঁশযুক্ত খাবার খান। যেসব শাক-সবজি ও খাবারে প্রচুর আঁশ রয়েছে সেসব খাবার খান। এতে আপনার টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম করে আঁশযুক্ত খাবার রাখুন খাদ্যতালিকায়। এতে রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৮। সূর্যতাপ গ্রহণ করুন। ভিটামিন ডি দেহের ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। আর সূর্যতাপ ভিটামিন ডি গ্রহণের অন্যতম উপায়। তাই নিয়মিত সূর্যতাপ গ্রহণে ডায়াবেটিস দূরে থাকে।
৯। কফি পান করুন। বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন অন্তত দুই কাপ কফি পান করলে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে ২৯%। তবে চিনি ছাড়া কফি পান করতে হবে। কফিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান এই কাজ করে।
১০। ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন। আজকাল চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায় নানা ধরনের ফাস্টফুড। যা দেখে হয়তো লোভ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু ফ্রাইস, পিজ্জা, বার্গার এর মতো ফাস্ট এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে স্থুলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, হজমে সমস্যা এবং হৃদরোগের মতো নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এসব খাবার দেহে ইনসুলিনের মাত্রায়ও ক্ষতিকরভাবে হেরফের ঘটিয়ে দিতে পারে। যা থেকে ডায়াবেটিসও হতে পারে।
১১। দারুচিনি খান। দারুচিনি তেল বা পাউডার আকারে নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে ৪৮%! গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দারুচিনির আছে অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা কমিয়ে আনার প্রাকৃতিক সক্ষমতা। আর এই দুটি উপাদান প্রাকৃতিক ভাবে কমিয়ে আনতে পারলে রক্তে সুগারের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে আসে।
১২। সালাদ খান। প্রতিদিন অন্তত এক বাটি সালাদ খান। যার মধ্যে থাকবে গাজর, শসা, লেটুস, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। প্রতিদিন দুপুরে বা রাতে খাবার খাওয়ার আগে এই সালাদ খেতে হবে। সালাদে এক চা চামচ ভিনেগারও যুক্ত করতে পারেন। ভিনেগার রক্তকে কমমাত্রায় সুগার শোষণে সহায়তা করে। আর রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমবে।
১৩। অত্যাধিক শুয়ে-বসে জীবন যাপনের পদ্ধতি বাদ দিন। যারা দীর্ঘক্ষন বসে কাজ করেন তারা মাঝে মাঝে উঠে দাড়িঁয়ে কিছুক্ষন হাটুন।
১৪। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন।মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগও হতে পারে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে। সুতরাং আপনি যদি এমন কেউ হন যিনি প্রায়ই তীব্র মানসিক চাপে থাকেন তাহলে রিল্যাক্স করার নানা কৌশল এবং যোগ ব্যায়াম করে স্ট্রেস কমান। এতে আপনার দেহে কর্টিসোল হরমোনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাবে।
৭ টি খাদ্য যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
১। কাঁচা, সিদ্ধ বা ভাজা শাক-সব্জিঃ বেছে নিন সুস্বাদু ও অল্প শর্করার সব্জি যেমন: মাশরুম, পিয়াজ, বেগুন, টমেটো, ব্রাসেলস স্প্রাউটস, গাজর, মুলা,করলা, ক্যাপসিকাম, ধুন্দুল সাথে ব্যবহার করুন রসুন, গোলমরিচ, সস ইত্যাদি।
২। সবুজ শাক-সব্জিঃ সবুজ শাক-সব্জির হিসেবে বেছে নিন পুঁই শাক, ডাটা শাক, কঁচু শাক, কলমি শাক, পালং শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, লেটুস পাতা, মটরশুঁটি, ঢেঁড়স, শালগম ইত্যাদি।
৩। সুস্বাদু, কম ক্যালোরিযুক্ত পানীয়ঃ লেবু ও শসার জুসে বরফের টুকরা ও মসলা মিশিয়ে পান করতে পারেন। লেবু অথবা দারচিনির টুকরা দিয়ে পান করতে পারেন চা।
৪। তরমুজ ও বেরি বা জামঃ তরমুজ ও বেরিতে রয়েছে ফাইবার ও নিউট্রিয়েন্টস। টক দই এর ভিতর বরফের টুকরা এবং তরমুজ ও জাম মিশ্রিত করে খেতে পারেন।
৫। আস্ত শস্যদানা, অধিক আশঁযুক্ত খাদ্যঃ শুকনো মটরশুঁটি, বুট, বাদাম, কলাই, মশুর, আস্ত গমের আটার রুটি, ঢেঁকি ছাঁটা চাল, ভুট্টা, বার্লি ইত্যাদি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৬। অল্প চর্বিঃ প্রাণীজ চর্বির পরিমাণ কমিয়ে উদ্ভিজ চর্বির পরিমাণ বাড়ানো উচিত। সম্পৃক্ত চর্বি যেমন- ঘি, মাখন, চর্বি ডালডা, চর্বিযুক্ত মাংস ইত্যাদি কম খেতে হবে। এর পরিবর্তে অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন- উদ্ভিজ তেল অর্থাৎ সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, অলিভ অয়েল এবং চর্বিযুক্ত মাছ খেতে হবে।
৭। আমিষঃ ভাল আমিষগুলি হচ্ছে গ্রীক ইয়োগার্ট, নরম পনির, ডিম, ফ্যাট ছাড়া দুধ (স্কিমড মিল্ক), মাছ, মাংস (ফ্যাট ছাড়া), পিনাট বাটার ইত্যাদি।
ডায়াবেটিস থাকলে এই ১১ টি খাবার এড়িয়ে চলুন।
১। চিনিযুক্ত পানীয়ঃ ডায়াবেটিস রোগীদের চিনিযুক্ত পানীয় বর্জন করা উচিত। সোডা ও মিষ্টি পানীয়তে থাকে উচ্চ মাত্রার শর্করা যা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।
তাছাড়াও এতে থাকা উচ্চ ফ্রুক্টোজ ইনসুলিনের প্রতি কোষের সাড়া না দেওয়ার জন্য দায়ী ফলে ওজন বাড়া, ফ্যাটি লিভার এবং অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২। ট্রান্স ফ্যাটঃ বাজারজাত যে কোনও ডুবো তেলে মুচমুচে করে ভাজা খাবার হচ্ছে ট্রান্স ফ্যাটে ভরা৷ সাধারণত হাইড্রোজেনেটেড তেলেই তা ভাজা হয়, একবার ব্যবহারের পর যে বাড়তি তেল থাকে,
সেটা লাগাতার ব্যবহার করা হয়৷ পুরোনো তেল ফেলে দেওয়া হয় না৷ আলুর চিপস, তেলেভাজা, শিঙাড়া, জিলিপি, কচুরি, পকোড়া, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার ইত্যাদিতে প্রচুর ট্রান্স ফ্যাট থাকে যা ইনসুলিনের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ে এবং পেটের নিচে মেদ জমার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
৩। হোয়াইট ব্রেড, পাস্তা, সাদা ভাতঃ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স হল খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করার পরিমাণ কতটা বাড়ছে তার আপেক্ষিক পরিমাপ। এর মাত্রা বাড়লে রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ে। এড়িয়ে চলুন হোয়াইট ব্রেড, পাস্তা, সাদা ভাত। এগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়।
৪। ফ্রুট-ফ্লেভার্ড দইঃ দই খেতে ভালবাসেন না এমন মানুষ বিরল। বিশেষজ্ঞদের মতে, দই খেতে হলে ঘরে পাতা দই খান। বাজার থেকে ক্রয় করা নানা রকম ফ্লেভার দেওয়া দই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
৫। মিষ্টিযুক্ত ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালঃ সিরিয়াল ধরণের খাবারগুলো ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়াও ইনস্ট্যান্ট ধরণের স্বাস্থ্যকর ওটমিলও ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সিরিয়ালগুলো আতিমাত্রায় প্রসেস করা যা শর্করাতে ঠাসা হলেও আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টিগুন খুবই কম।
৬। ফ্লেভার্ড কফি ড্রিংসঃ ফ্লেভার্ড কফি ড্রিংসকে তরল মিষ্টি বলা চলে। এতে থাকে উচ্চ তরল শর্করা যা রক্তে সুগার লেভেল বৃদ্ধি করে এবং একই সাথে আপনার খিঁদে মেটাতেও ব্যর্থ হয়।
৭।মধু, জ্যাম, জেলিঃ প্রাতরাশে কি রোজ এগুলোই খান? তাহলেই এখনই ডায়েট চার্ট থেকে এদের বাদ দিন। বাজারচলতি মধু, জ্যামে থাকে 'আর্টিফিশিয়াল সুগার', যা স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই ভাল নয়। এছাড়া প্রকৃতির মধুও রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ায়।
৮। শুকনো ফলঃ ফল ভিটামিন সি ও পটাশিয়াম সহ বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের সবচেয়ে ভালো উৎস।যখন ফল শুকানো হয় তখন পানি কমে যায়। কাজেই ফলে থাকা পুষ্টি উপাদানের ঘনত্ব বেড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত এতে থাকা চিনির পরিমান আরো বেড়ে যায়। আঙুরের তুলনায় কিসমিসে তিনগুন শর্করা থাকে।অন্যান্য শুকনো ফলেও সতেজ ফলের চেয়ে বেশি শর্করা থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের এসব এড়িয়ে চলতে হবে। সতেজ জাম ও ছোট একটা আপেল রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেই আপনাকের স্বাস্থ্য উপকারিতা নিশ্চিত করতে পারে।
৯। প্যাকেটজাত স্ন্যাক ফুডসঃ প্যাকেটজাত চিপস, মুচমুচে বিস্কুট এগুলো স্বাস্থ্যকর নয়। এগুলো রিফাইন্ড আটার তৈরি যাতে পুষ্টিমান খুবই কম থাকে। এতে থাকে দ্রুত হজম হয় এরকম শর্করা যা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
১০। ফলের জুসঃ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে সোডা বাদ দিয়ে ফলের জুস পান করেন? তাহলে জেনে রাখুন, বোতলজাত ফলের জুস পান করা এবং সোডা পান করার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই।
কারণ ফলের জুসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুগার ও ক্যালরি যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর চেয়ে ভাল হয় আপনি পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন যাতে শর্করা ও ক্যালরি নেই বললেই চলে।
১১। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইঃ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এড়িয়ে চলুন। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর প্রধান উপাদান আলু। আলুর খোসা ছাড়িয়ে অস্বাস্থ্যকর ডুবো তেলে ভাজা হয়। খোসা ছাড়ানোর কারনে শর্করার পরিমান বেড়ে যায় এবং সাথে পোড়া তেলে ভাজার কারনে খাবারটা খুবই অস্বাস্থ্যকর।
এটা রক্তে সুগারের পরিমান দ্রুত বাড়িয়ে দেয়।
সমাপ্ত।
© শফিকুল ইসলাম।