মাতৃভাষার প্রভাব। এস এম শামসুল আলম

 

মাতৃভাষার প্রভাব


মাতৃভাষা হলো সেই ভাষা, যা একজন মানুষ মায়ের কোল থেকে শেখে, যা তার চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও অভিব্যক্তির প্রধান মাধ্যম। এটি শুধু কথ্য বা লেখ্য ভাষাইনয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতিগত পরিচয়েরও ধারক। মাতৃভাষার প্রভাব ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে অপরিসীম। এটি আমাদের চিন্তা-ভাবনা, আবেগ, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত। মাতৃভাষা শুধু ভাষা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের অংশ। এটি আমাদের চিন্তা, সংস্কৃতি ও স্বপ্নের বাহক। মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। কারণ, মাতৃভাষাই আমাদেরকে পৃথিবীতে অনন্য করে তোলে।

 ব্যক্তিগত বিকাশে মাতৃভাষার প্রভাব

মাতৃভাষা ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণকারী শিশুরা দ্রুত শেখে এবং তাদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা বেশি বিকশিত হয়। মাতৃভাষায় চিন্তা করা সহজ হওয়ায় ব্যক্তি তার মনের ভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে, যা তার আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। মাতৃভাষায় কথা বলার সময় আমরা শুধু শব্দই উচ্চারণ করি না, আমাদের আবেগ, অনুভূতি ও স্মৃতিও তার সাথে জড়িয়ে থাকে। এটি আমাদের মানসিক স্থিতিশীলতা ও আত্মীয়তার বন্ধনকে মজবুত করে। মাতৃভাষায় প্রকাশিত সাহিত্য, কবিতা, গান ও শিল্প আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং আমাদেরকে নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত রাখে।

সামাজিক বন্ধনে মাতৃভাষার ভূমিকা

মাতৃভাষা সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে। পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে মাতৃভাষা একটি শক্তিশালী সংযোগ সৃষ্টি করে। এটি পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহমর্মিতা ও ঐক্য গড়ে তোলে। মাতৃভাষায় কথা বললে মানুষ একে অপরের সাথে সহজেই সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, যা সামাজিক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখে। মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধকে ধারণ করি এবং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিই। এটি আমাদেরকে আমাদের শিকড়ের সাথে যুক্ত রাখে এবং আমাদেরকে একটি স্থিতিশীল ও সুরক্ষিত ভিত্তি প্রদান করে।

জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতিতে মাতৃভাষার অবদান

মাতৃভাষা জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতির প্রতীক। এটি একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। মাতৃভাষার মাধ্যমে একটি জাতির সাহিত্য, সংগীত, শিল্প ও দর্শন সংরক্ষিত ও প্রচারিত হয়। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদা জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জোগায়, যেমন বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। মাতৃভাষা আমাদের আত্মপরিচয়েরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি আমাদেরকে পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতি ও ভাষার থেকে আলাদা করে। মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধকে ধারণ করি এবং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিই। এটি আমাদেরকে আমাদের শিকড়ের সাথে যুক্ত রাখে এবং আমাদেরকে একটি স্থিতিশীল ও সুরক্ষিত ভিত্তি প্রদান করে।

শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব

মাতৃভাষার প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রেও অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বিদেশি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণকারীদের তুলনায় বেশি সফল হয়। কারণ, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তু দ্রুত বুঝতে পারে এবং তাদের মধ্যে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এটি তাদের মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়াও, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারে, যা তাদেরকে সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ

তবে, বিশ্বায়নের যুগে মাতৃভাষার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। বিদেশি ভাষার প্রভাবে অনেক মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে মাতৃভাষার অস্তিত্ব নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির প্রভাবে অনেক মানুষ তাদের মাতৃভাষার চেয়ে বিদেশি ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এটি মাতৃভাষার অবমূল্যায়ন ও অবহেলার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই, মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও প্রচারে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি পর্যায়ে মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরা এবং এর ব্যবহার বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

 

মাতৃভাষা শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি আমাদেরকে আমাদের শিকড়ের সাথে যুক্ত রাখে এবং আমাদেরকে পৃথিবীতে অনন্য করে তোলে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা এবং এর বিকাশে কাজ করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, মাতৃভাষাই আমাদেরকে আমাদের প্রকৃত পরিচয় দেয় এবং আমাদেরকে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। কারণ, মাতৃভাষাই আমাদেরকে পৃথিবীতে অনন্য করে তোলে।

 এস এম শামসুল আলম
ইন্সট্রাক্টর(সাধারণ)
পিটিআই, খুলনা

2 Comments

  1. লেখাটি খুবই অসাধারণ। বিশ্লেষণমূলক ও তথ্য বহুল । খুব ভালো লেগেছে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post

হেলথ টিপস