"বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা"
২০২৪ এর আগষ্টে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ হওয়া হাজার হাজার তাজা প্রাণের বিনিময়ে যে নতুন বাংলাদেশকে আমরা পেয়েছি, সে দেশের সকল ক্ষেত্র প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যহীন হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা। আর এমন বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন বৈষম্য বিরোধী মানসিকতার সুদক্ষ কারিগর। সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত, মিল, কল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী ও বিভিন্ন পেশাজীবীর অধিকাংশের চিন্তা, চেতনা ও মানসিকতা যদি বৈষম্য বিরোধী হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তবেই প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যহীন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে সম্ভব। তাই, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া দরকার- এদেশের আপামর জনসাধারণসহ বিভিন্ন পেশা ও দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের বৈষম্য বিরোধী মানসিকতা সৃষ্টি করা। তবে, কাজটা কি এতই সহজ? মোটেই না। কারণ বড়দের অভ্যাস ও মানসিকতা পরিবর্তন করা এত সহজ নয়। কোন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠে একদিনে গড়ে ওঠে না। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অভিজ্ঞতা ও সাধিত আচার-আচরণের প্রেক্ষিতে তৈরি হয় তার অভ্যাস, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। কেউ চাইলেই তা সহজে পরিবর্তন করা যায় না। বড়রা তাদের নিজের গভীর ইচ্ছা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছাড়া নিজেকে কখনো করতে পারেন না। আর সবার ক্ষেত্রে সে পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব কমই দেখা দেয়।
তাই তো কথায় বলে- "কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস"। এই এই প্রবাদ বাক্যটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত। এটির ভাব অর্থ থেকে প্রকাশিত হয় যে, শিশুকালে যদি শিশুর সঠিকভাবে চরিত্র বা আচরণ গঠন না হয়, তবে বয়সকালে সেটা কখনোই আর সম্ভব হয় না।
আমরা জানি, শিশুর প্রথম বিদ্যালয় হল তার পরিবার। তবে পরিবার থেকে শিশুর শিখনের শুরুটা হলেও, মূলতঃ শিখনের ভিত রচিত হয় প্রাথমিক শিক্ষা স্তরেই। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের শিশুরা সর্বোত্তম পর্যায়ে অনুকরণ অনুসরণ প্রিয় হয়ে থাকে। এ সময়ে শিশুর মস্তিষ্ক থাকে অনেকটা খাতার সাদা পাতার মতো। সাদা খাতায় ঠিক বা ভুল যাই হোক না কেন, কোন কিছু একবার লিখলে তা যেমন কখনোই পুরাপুরি মুছে ফেলা যায়না; তেমনি আচরণের ক্ষেত্রেও শিশু তার শৈশবকালে বা প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে যা কিছু শেখে বা আচরণিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে তা তার বাকী জীবনের আচরণকে অনেকটাই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। বয়স বৃদ্ধির সাথে বা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার অর্জনে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন আসলেও শিশুকালে অর্জিত আচরণিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ভবিষ্যৎ আচরণের ভিত হিসাবে স্থায়ী রূপ ধারণ করে এবং সে আচরণিক বৈশিষ্ট্যসমূহ দ্বারা মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিচালিত হয় আজীবন।
এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা কাকে বলে বা শিক্ষা বলতে মোটের উপর আমরা কী বুঝি? শিক্ষার বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, যা কিছু অর্জনের মধ্য দিয়ে শিশুর বা কোন ব্যক্তির আচরণের কাঙ্ক্ষিত ও স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে এবং তা তার বাস্তব জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রয়োগ করার সক্ষমতা তৈরি করে, তাই শিক্ষা। অর্থাৎ, শিক্ষার সংজ্ঞার বিশ্লেষণ থেকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করতে পারি। যেমন - কোনো বিষয়ে প্রকৃত শিখন অর্জন হলে তার প্রভাবে ব্যক্তির আচরণে ইতিবাচক ও স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে। এছাড়া, আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণে ব্যক্তি তার শিখনকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে বা কাজে লাগাতে আগ্রহী ও সমর্থ্য হন এবং কোনো বিষয়ে শিখন সংঘটিত হলে তা ব্যক্তির নিজস্ব আচরণে জীবনকাল ব্যাপী প্রভাব ফেলে থাকে।
প্রাথমিক শিক্ষা সেই শিক্ষা, যা শিশুর ভবিষ্যৎ রচনায় ভিত স্বরূপ ভূমিকা রাখে। তবে,সেই প্রাথমিক শিক্ষা হওয়া দরকার মানসম্মত। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য শুধুমাত্র শিশুর স্বাক্ষরতা অর্জন করানো নয়। শিশুর শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধনে সহায়তা করা প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হলে, বাংলাদেশের আগামী দিনের আদর্শ নাগরিক হতে যাওয়া এ শিশুরাও বৈষম্যহীন মানসিকতা নিয়ে বড় হবে এটা প্রত্যাশা করা যায়। একটা দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন করা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটাও ঠিক যে, বাংলাদেশের সকল শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা মোটেও সহজ কাজ নয়। কারণ বাংলাদেশের সকল শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি রয়েছে আরও নানান ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সকল ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার কর্তৃক সরবরকৃত বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার ও শিখন সামগ্রীর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলেও আরো কিছু অতিরিক্ত পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যতীত অন্যান্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যার প্রভাবে প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশু শিক্ষার্থীদের শিখন ও আচরণে ভিন্নতা বা বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এইজন্য প্রতিটি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণ করা অত্যন্ত জরুরী।
কারণ, মানসম্মত শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে- একীভূত শিক্ষা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করা না গেলে আমাদের সকল শিশুকে আগামী দিনের বৈষম্যহীন নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেননা, একটি শিশু যখন সহপাঠী বা বন্ধু রূপে সমাজের সকল ধরণের শিশুর সাথে মেশার সুযোগ পায়, তখন শিশুদের মধ্যকার ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যকে সে স্বাভাবিক হিসাবে গ্রহণ করতে শেখে। শিশু বা মানুষের মধ্যকার ভিন্নতা বা বৈচিত্রকে যে শিশু তার শৈশব থেকে স্বাভাবিক মনে করতে শেখে বা মেনে নিতে শেখে, সে অন্তত ভিন্ন শিশু বা মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না বা ভিন্ন ধরণের মানুষ হিসাবে বিবেচনা করবে না। মানুষ হিসাবে যে সবাই এক; সেটা শিখতে গেলে সকল ধরনের শিশুর বিদ্যালয়ে সহাবস্থানের মাধ্যমে শিখনের পরিবেশ নিশ্চিত করা অতি জরুরি। আর এটি কেবল একীভূত শিক্ষার যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। সেক্ষেত্রে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একীভূত শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, একীভূতকরণের মাধ্যমে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিশুর জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব হলে আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বৈষম্যহীন, প্রতিটা প্রতিষ্ঠান হবে বৈষম্যহীন ও বিশ্বের মানচিত্রে নতুন বাংলাদেশের গর্বিত নাম হবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। আর তাই, প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে বর্তমান সরকারকে। মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, দিতে হবে শিক্ষকের সর্বোচ্চ মর্যাদা, সম্মান ও সম্মানি। তাদের হাত ধরে গড়ে উঠবে এদেশের আগামী দিনের নাগরিক। আর আর সেই সব আদর্শ নাগরিকরাই গড়ে তুলবে প্রকৃত বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ।
মোঃ রুহুল আমিন,
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার,
ফুলতলা, খুলনা।