"সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে; কারণ ও প্রতিকার"
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিশুর সার্বিক বিকাশের নিরিখে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থী ভর্তি ও সরজমিন বিদ্যালয় পরিদর্শনের তথ্য বিশ্লেষণপূর্বক নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এমনই। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি অবগত এবং উদ্বিগ্নও বটে। এ প্রেক্ষিতে, ইতোমধ্যে ৫০ জনের কম শিক্ষার্থী বিশিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পার্শ্ববর্তী কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালইয়ের সাথে একীভূত করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে ও তার বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের শিশু জরিপের তথ্যে, বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এলাকার বিদ্যালয় গমন উপযোগী শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে না কমলেও, নানাবিধ কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমেছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০০৪ সালে যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫০ জন, সেখানে ২০০৪ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন। এমনকি, ভর্তির পরেও প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে অভিভাবকগণ সরিয়ে নিয়ে ভর্তি করছেন অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ একটি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে "শিশু শিক্ষণ বিজ্ঞান (Pedagogy)" অবলম্বনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, সহযোগিতামূলক, কর্মভিত্তিক ও অর্ন্তভুক্তিমূলক শিক্ষার যে আয়োজন, তার কোনো বিকল্পও নেই। লক্ষ লক্ষ সুদক্ষ শিক্ষক, কর্মকর্তা- কর্মচারীর সমন্বয়ে সমৃদ্ধ জনবল দারা পরিচালিত দেশের প্রতিটি গ্রাম, শহর, হাওড়-বাওড়, চর, দ্বীপ, বন, পাহাড় ও সমতলে বিস্তৃত সর্ববৃহৎ সংখ্যার এ যর্থার্থ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে খ্যাত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এভাবে কমে যাওয়া যে আগামীর উন্নত বাংলাদেশ গঠনের জন্য মোটেও ইতিবাচক বা শুভকর নয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাথমিক শিক্ষার সাথে দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততা ও কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এটা প্রতিভাত যে, নানাবিধ কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার দিন দিন কমে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল, নতুন এ বাংলাদেশের কল্যাণে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাওয়ার কারণসমূহ চিহ্নিত করা এবং তা নিরসনের উপায় নির্ধারণ করে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী। সরজমিন বিদ্যালয় পরিদর্শনের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষক- শিক্ষার্থী-অবিভাবকগণের সাথে নিবিড়ভাবে মতবিনিময় ও মিথস্ক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ক্রমাগত শিক্ষার্থী ভর্তির হার তথা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ ও প্রতিকারের উপায় নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হলো-
১. এখনো দেশের বেশিরভাগ অভিভাবক, শিশু শিক্ষা বলতে- শিশুর পড়তে ও লিখতে জানা এবং পাঠ মুখস্থ করাকে বোঝেন। শিশুকাল থেকেই বড় মাপের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে সাধারণ জ্ঞান, ইংরেজিসহ একাধিক ভাষা শেখার বড় আয়োজনের মধ্যে ঠেলে দেওয়াকে অনেকে আধুনিক ও উন্নত শিক্ষা কার্যক্রম মনে করেন। শিশুর স্বাভাবিক ও সার্বিক বিকাশ এবং তার গুরুত্ব এখানে উপেক্ষিত। অন্যদিকে, শিক্ষক ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা এমনকি গণমাধ্যম কর্তৃক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রদানকৃত সেবা ও সুবিধাসমূহ এবং শিশুর সার্বিক বিকাশ ও শিশু শিক্ষার আধুনিক পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক প্রচারণার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলশ্রুতিতে, অধিকাংশ অভিভাবকের এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। শিক্ষক ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ কর্তৃক নিয়মিত বিদ্যালয়ে মা ও অভিভাবক সমাবেশ, হোম ভিজিট ও বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার বিভিন্ন পাড়ায় উঠান বৈঠক এর আয়োজন করে এবং গণমাধ্যম কর্তৃক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেবা ও সুবিধাসমূহ, শিশুর বিকাশ ও শিশু শিক্ষার আধুনিক পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে অভিভাবকগণকে যদি সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাহলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।২. অনেক অভিভাবক "মানত" জনিত কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানকে হঠাৎ সরিয়ে নিয়ে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেন এবং সেখানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার বিষয়টি অনুভূত হওয়ার পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন অপারগতা ও বড় আকারের শিখন ঘাটতি নিয়ে আবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিরে আসে। আর, তাদের সেই শিখন ঘাটতি সহজে পূরণ করা সম্ভব হয়না। ফলস্বরূপ, অনেক শিক্ষার্থী একসময় বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে। এক্ষেত্রে, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ কর্তৃক নিয়মিত বিভিন্ন জনসংযোগমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে (মা/ অভিভাবক সমাবেশ, হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক প্রভৃতি।) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার মান ও তার সুফল নিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা হলে এরূপ বিড়ম্বনা থেকে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকগণ ও তাদের সন্তানরা রক্ষা পাবে।৩. অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাকে অনেকাংশে নেতিবাচক বা মর্যাদা হানিকর মনে করেন। কারণ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকল শ্রেণির শিশুর (সকল শ্রেণি-পেশার অভিভাবকের সন্তানের) একসাথে শিক্ষা গ্রহণের যে সুযোগ রাখা হয়েছে; কিছু অভিভাবক সে বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষন করেন। যার কারণে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এড়িয়ে তাদের সন্তানকে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেন। সেখানে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উচ্চ বেতনে সন্তানের জন্য নিম্নমানের শিক্ষা ও সেবা ক্রয় করেন। অথচ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে শিশুর সার্বিক বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে অবৈতনিক ও মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের অপার সুব্যবস্থা। এক্ষেত্রে, শিক্ষক ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ এবং গণমাধ্যম কর্তৃক "সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একীভূত শিক্ষা ও এর সুফল" বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিতকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবেন।৪. দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫+ বয়সী শিশুদের জন্য ১ বছর মেয়াদী প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও ২০২৩ সাল থেকে পাইলটিং হিসাবে উপজেলার প্রতিটি ক্লাস্টার থেকে ১টি বিদ্যালয়ে ৫+ বয়সী শিশুদের পাশাপাশি ৪+ বয়সী শিশুদের জন্য পৃথক আর একটি প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি, অর্থাৎ ২ বছর মেয়াদী প্রাক প্রাথমিক কার্যক্রম চালু করা হয়। অদ্যবধি, দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪+ বয়সী শিশুদের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু না হওয়ার এই সুযোগটি গ্রহণ করছে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে, অভিভাবকগণ শিশুর বয়স ৪ বছর পূর্ণ হতে না হতেই ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন ঐ সকল বাহ্যিক চাকচিক্যময় বৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ফলে, শিক্ষার্থী হারাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এমতবস্থায়, কোমলমতি শিশুদের বইয়ের বোঝা ও মুখস্থ বিদ্যা থেকে রেহাই দিতে এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিশুর সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনতিবিলম্বে ৪+ বয়সী শিশুদের জন্য ১ বছর মেয়াদী প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার আরও একটি শ্রেণি কার্যক্রম চালু করা জরুরী।৫. অন্যান্য শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি উপলক্ষ্যে শিক্ষা বছরের শুরুতে অভিভাবকগণকে আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য তেমন কোনো বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয় না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি চলাকালে (ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় অর্ধ থেকে জানুয়ারি মাসব্যাপী) শিক্ষকগণ কর্তৃক জনসংযোগ করে অর্থাৎ জোড়ায় বা দলে বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এলাকার প্রত্যেকটি বাড়িতে সরজমিন ভিজিট করে অভিভাবকগণকে তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করতে হবে। এছাড়া, শিক্ষার্থী ভর্তি উপলক্ষ্যে ব্যানার-ফেস্টুনে ও মাইকিং এর মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুবিধা, সুফল ও পড়ালেখার গুণগত মান সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা করলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বৃদ্ধি পাবে।৬. শিক্ষকতাকে সেবামূলক পেশা হিসেবে গ্রহণ না করে শুধুমাত্র চাকুরী হিসাবে গণ্য করা কিছু শিক্ষকের দায়সারা মনোভাব ও নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দায়িত্ব পালনের প্রবনতা অহরহ লক্ষ্য করা যায়। যার কারণে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষা ও সেবা মান নিম্নগামী; যে কারণে ওই সকল শিক্ষক ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে অনাস্থা এবং তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপরে। এক্ষেত্রে, ঐ সমস্ত শিক্ষকগণকে পেশার প্রতি দায়িত্বশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী উন্নতমানের প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন। এছাড়া, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের পেশাগত কাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পুরস্কার ও শাস্তির প্রচলিত বিধি-বিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ করা জরুরি।৭. বিদ্যালয়ে যেখানে একাডেমিক বা শ্রেণি শিখন-শেখানো কাজ মুখ্য, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষককে বিদ্যালয় চলাকালে একাডেমিক কাজের চেয়ে প্রশাসনিক কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতে লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া, বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট শিক্ষককে জবাবদিহি করতে হলেও একাডেমিক কাজের জন্য তেমন জবাবদিহি করতে হয় না। বিধায়, শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ে একাডেমিক কাজের চেয়ে প্রশাসনিক কাজ-কেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান দুর্বল হয়ে পড়ে। যার প্রভাবে, সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমছে। এক্ষেত্রে, শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণকে বিদ্যালযয়ের একাডেমিক বা শিখন শেখানো কাজকে প্রাধান্য বা গুরুত্ব দিতে হবে এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ কর্তৃক শিক্ষকগণের একাডেমিক কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে, বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ সম্পাদনসহ প্রধান শিক্ষককে দাপ্তরিক কাজে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন "অফিস সহায়ক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর" নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।৮. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর "কন্টাক্ট আওয়ার" বা বিদ্যালয়ে শিশুর অবস্থানের সময় অন্যান্য শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি হাওয়ায় অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চান না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর "কন্টাক্ট আওয়ার" বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ও তার প্রভাব সম্পর্কে অভিভাবকগণের সুস্পষ্ট ধারনা না থাকার কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে তুলনামূলক কম সময়ব্যাপী চলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে আগ্রহী। বিধায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমছে। এক্ষেত্রে, শিক্ষক/ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ কর্তৃক মা/ অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিট এর মাধ্যমে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর "কন্টাক্ট আওয়ার" বৃদ্ধির চুক্তিতে স্বাক্ষর করার প্রেক্ষিতে বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীর সহাবস্থানের সময় বৃদ্ধি তথা সরকার কর্তৃক ক্রমান্বয়ে দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এক শিফটে রূপান্তরকরণের পরিকল্পনার যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি এবং প্রতিদিন তাদের সন্তানকে বাড়িতে তৈরি খাবার টিফিন বক্সে সরবরাহ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সম্ভব হলে স্থানীয় পর্যায়ে বা সরকার কর্তৃক অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া, যৌক্তিকতার নিরিখে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিখনের বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও প্রতিদিনের পিরিয়ড সংখ্যার কিছু কমানো যেতে পারে।৯. পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম-২০২১ এর ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকগণের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় অভিভাবকগণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সন্তানকে সরিয়ে নিয়ে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করছেন। এক্ষেত্রে, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও তা প্রয়োগ উপযোগী করতে হবে এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক উদ্বুদ্ধকরণ সভা আয়োজনের মাধ্যমে অভিভাবকগণকে আধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করতে হবে।১০. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দৈনিক সমাবেশ, টিফিন পিরিয়ডের খেলাধুলা, শিল্পকলা বিষয়ে পদ্ধতি অনসারে পাঠদান, শারীরিক শিক্ষার চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, কাবিং কার্যক্রম, স্টুডেন্ট কাউন্সিল, এসআরএম পড়া ও লাইব্রেরির ব্যবহারসহ বিভিন্ন সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলী অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তা অধিকাংশ বিদ্যালয়ে পদ্ধতি অনুসারে ও গুরুত্বের সাথে নিয়মিত অনুশীলন করানো হয় না এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে শিক্ষার্থীদের তেমন দক্ষতাও বৃদ্ধি পায় না। যার কারণে, বিদ্যালয়টি শিশুর সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্র না হয়ে শুধুমাত্র ভাষা ও গণিত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে শিশুদের কাছে নেতিবাচক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়। এমন বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় নয় এবং শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহী হয় না; ফলে বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এক্ষেত্রে, বিদ্যালয়ের SLIP ফান্ড থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী ও সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীর জন্য সহায়ক উপকরণ ক্রয়কে গুরুত্ব দেওয়া দরকার এবং শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণ কর্তৃক উল্লেখিত সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীসমূহ সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গুরুত্বের সাথে নিয়মিত অনুশীলন ও তদারকি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
১১. কর্মকর্তাগণ কর্তৃক পরিদর্শনকৃত বিদ্যালয়সমৃহে নিয়মিত "ফলোআপ (Follow up)" পরিদর্শন না করার কারণে শিক্ষকগণের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিসহ বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে, কর্মকর্তাগণ কর্তৃক পরিদর্শনকৃত বিদ্যালয়সমৃহে নিয়মিত "ফলোআপ (Follow up)" পরিদর্শন করতে হবে। এতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সার্বিক মান বৃদ্ধি পাবে।১২. বর্তমান চাকরির গ্রেড, বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদার নিরিখে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের অনেকেরই কর্মসন্তুষ্টি (Job satisfaction) নেই বলে প্রতীয়মাম হয়; যা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের অন্যতম বড় বাধা। যদিও বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পেলেই শতভাগ শিক্ষকের কাজের মান বৃদ্ধি পাবে এমনটি নিশ্চিত করে বলা না গেলেও দেশের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের বাজারদরের সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষকের পরিবারের সদস্যগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার মতো যদি আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা না যায় এবং তাতে ঐ শিক্ষকের দ্বারা তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা অভাব বা কর্মে অসন্তুষ্টি তৈরি হলে তাঁকে দিয়ে আর যাই হোক মানসম্মত শিখন-শেখানো কাজ বা শিশুদের ভালো মানুষ গড়ার কাজটি প্রত্যাশা করা কঠিন। তাই, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের চাকরির গ্রেড উন্নীতকরণ বা সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বিশেষ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা গেলে তাঁদের কর্মসন্তুষ্টি (Job satisfaction) সৃষ্টি হবে এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি পূর্ণ দায়িত্বশীলতা, কর্মস্পৃহা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধির প্রত্যাশায় বিশেষ কোনো বাঁধা থাকবে না।১৩. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে শিশুর "জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং অন্য স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থী হলে বদলি সনদ (Transfer certificate) জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক; তাই জন্ম নিবন্ধন না থাকার কারণে অনেক শিশুকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। তবে, অন্যান্য শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে কোন জন্ম নিবন্ধন সনদ বা বদলি সনদ (Transfer certificate) লাগে না। ফলে, জন্ম নিবন্ধন নেই এমন শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। এক্ষেত্রে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুর ভর্তির ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং প্রয়োজনে বদলি সনদ (Transfer certificate) এর কপি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এতে, একজন শিক্ষার্থীকে একাধারে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার আর সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে, অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে ভর্তি করাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেই বেঁছে নেবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়। এতে করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।১৪. সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট জনবল, তথা শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনেকের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না করার কারণে সাধারণ অভিভাবক মনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষার মান নিয়ে সন্দেহ ও দ্বিধার সৃষ্টি হয় ; ফলে তারা তাদের সন্তানকে সেখানে ভর্তির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাই, প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তানদেরকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করার বিষয়ে রাষ্ট্রের বিশেষ নির্দেশনা থাকা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের জনবলের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের প্রতি আন্তরিকতা যত্ন ও পরিচর্যা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সাধারণ অভিভাবক মনেও বিদ্যালয় ও শিক্ষার মান নিয়ে সংশয় দূরভীত হবে। ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হার বৃদ্ধি পাবে।১৫. বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়; শিক্ষকের (নারী শিক্ষকের) এমন শিশু সন্তানকে কর্মদিবসে বিদ্যালয়ে এনে তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা বা তার পরিচর্যা করতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার প্রবণতার কারণে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের অভিভাবকগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়; এমনকি অন্যান্য সহকর্মী শিক্ষকগণের মধ্যেও এটা নিয়ে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে, বিষয়টি মানবিক হওয়ায় এমন সন্তানকে বিদ্যালয়ে আনতে হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সন্তানকে দেখভালের জন্য একজন আয়া বা পরিচারিকা (Caregiver) সাথে আনার সরকারি নির্দেশনা থাকতে হবে। পাশাপাশি শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান ও বিশ্রামের জন্য প্রতি বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে 'মাতৃদুগ্ধ পান কেন্দ্র (Feeding room)' বা 'Day Care Centre' স্থাপন করা যেতে পারে; যাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক মানসিক ভাবে সস্তিতে থাকতে পারেন এবং বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করতে পারেন।১৬. কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে এটা সবারই জানা। শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুপাতে শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ ও শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হলে ঐ সকল বিদ্যালয়ে মানসম্মত নিশ্চিত করা সহজ হবে এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। পরিশেষে বলা যায় যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্রমাগত শিশু ভর্তির হার নিম্নগামী হওয়ার চিহ্নিত কারণসমূহ এবং তা প্রতিকারে উল্লেখিত উপায়সমূহ মোতাবেক প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তনসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ক্রমশ বৃদ্ধি তো পাবেই; উপরন্তু, বাংলাদেশের শিশুরা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে একটি নতুন ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনের অগ্রগামী ও শক্তিশালী সৈনিক হিসেবে গড়ে ওঠার সু্যোগ পাবে।
মোঃ রুহুল আমিন,
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার,
ফুলতলা, খুলনা।
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার,
ফুলতলা, খুলনা।
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রত্যেকটা পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ,, ভীষণ উপকারী আপনার আইডিয়া গুলো...
ReplyDelete