বিরতিচিহ্ন বনাম ভাবচিহ্ন❓আব্দুল্লাহ আল নোমান । কর-পরিদর্শক নাটোর।

বিরতিচিহ্ন বনাম ভাবচিহ্ন❓



লেখার শিরোনাম দেখে মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, ‘ভাবচিহ্ন’ আবার কী। ‘বিরতিচিহ্ন’ নামের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এই বিরতিচিহ্নকেই আমরা আরও কয়েকটি নামে চিনে থাকি। সেগুলো হলো- ‘যতিচিহ্ন’, ‘ছেদচিহ্ন’, ‘বিরামচিহ্ন’ ইত্যাদি। কিন্তু ‘ভাবচিহ্ন’ শব্দটি অপরিচিত একটি শব্দ। এই শব্দটির সাথে যাঁরা ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী এবং যাঁরা ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা লেখনরীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন কেবল তাঁদেরই পরিচয় আছে।

‘ভাবচিহ্ন’ শব্দটির প্রস্তাবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের দুজন শিক্ষক ড. সাখাওয়াৎ আনসারী ও মোসাম্মাৎ মনিরা বেগম (আমার সৌভাগ্য আমি দুজনকেই আমার সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি)। তাঁরা দুজন “বৈশিষ্ট্যের মানদণ্ডে ‘বিরতিচিহ্ন’ অভিধার যথাযথতা: একটি পর্যালোচনা” নামক নিবন্ধে অত্যন্ত যৌক্তিক আলোচনা উপস্থাপন শেষে ‘বিরতিচিহ্ন’ অভিধার পরিবর্তে ‘ভাবচিহ্ন’ অভিধাটি ব্যবহারের প্রস্তাব করেন।

উল্লিখিত নিবন্ধটির সারসংক্ষেপ কয়েকটি বাক্যে বলার চেষ্টা করছি।

‘বিরতিচিহ্ন’ কী বা এর সংজ্ঞা কী- এরূপ প্রশ্নের বিপরীতে আমাদের চিন্তায় যে উত্তরটি সচরাচর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে উঁকি দেয় সেটি হলো- বাক্যের মধ্যে বিরতি নির্দেশে যে চিহ্ন ব্যবহৃত হয়, তাই ‘বিরতিচিহ্ন’। কিন্তু ‘বিরতিচিহ্ন’ কি কেবলই বাক্যে বিরতি নির্দেশেই ব্যবহৃত হয়? এর কি আর কোনো বৈশিষ্ট্য নেই? লেখকবৃন্দ দেখিয়েছেন যে, বিরতি নির্দেশ ছাড়াও ‘বিরতিচিহ্ন’ আরও অনেক বৈশিষ্ট্যের ধারক। বিরতিচিহ্নের বেশ কয়েকটি সংজ্ঞার্থ বিশ্লেষণ করে তাঁরা বিরতিচিহ্নের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করেছেন-

১. বিরতিচিহ্ন হলো এমন কিছু সাংকেতিক চিহ্ন, যা হস্তলিখন ও মুদ্রণে ব্যবহৃত হয়।
২. বিরতিচিহ্ন লিখিত ভাষার অর্থকে সুস্পষ্ট করে তোলে।
৩. বিরতিচিহ্ন বাক্যের বিভিন্ন সাংগঠনিক উপাদান তথা শব্দ, বাক্যাংশ, খণ্ডবাক্য, বাক্য প্রভৃতিকে পৃথক করে।
৪. ভাষা ব্যবহারকালে বক্তা যে মনোভঙ্গি প্রকাশ করে, বিরতিচিহ্ন তা যথাসাধ্য নির্দেশে সহায়তা করে।
৫. ভাষিক ও শরীরবৃত্তীয় কারণে বক্তা ভাষা ব্যবহারকালে যেভাবে বিরতি নেয়, বিরতিচিহ্ন তা নির্দেশে সহায়তা করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিরতি নির্দেশ করাই বিরতিচিহ্নের একমাত্র বা প্রধান উদ্দেশ্য নয়। এই দিকটি তুলে ধরার পাশাপাশি লেখকবৃন্দ আরও একটি যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন- বিরতিচিহ্নের অন্তর্ভুক্ত সবগুলো চিহ্নই কি বিরতি নির্দেশে ব্যবহৃত হয়?

তাঁরা দেখিয়েছেন যে, ১২টি বিরতিচিহ্নের মধ্যে ৮টি চিহ্নের জন্য বিরতিকাল রয়েছে, বাকি চারটির (<->, <’>, <.>, <() {} []>)  কোনও বিরতিকাল নেই। তাঁরা আরও বলেছেন যে, বন্ধনীচিহ্নের মধ্যে দ্বিতীয় বন্ধনীর ব্যবহার ভাষার মধ্যে পাওয়া যায় না, বরং এটি একটি গাণিতিক চিহ্ন। তাহলে ভাষার মধ্যে ব্যবহৃত আরও অনেক প্রতীক আছে, সেগুলো কি বিরতিচিহ্ন হবে না?

এ ধরনের কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরে লেখকবৃন্দ আমাদের প্রথাগত ব্যকরণে প্রচলিত ‘বিরতিচিহ্ন’-এর ধারণাটি নিয়ে নতুনভাবে ভাবার পথ উন্মোচন করে দিয়েছেন। আর আলোচনা শেষে তাঁরা যৌক্তিকভাবেই ‘বিরতিচিহ্ন’ অভিধাটির পরিবর্তে ‘ভাবচিহ্ন’ অভিধাটি প্রস্তাব করেছেন। তাঁদের এই প্রস্তাব প্রথাগত ব্যাকরণের বহুল প্রচলিত ‘বিরতিচিহ্ন’ অভিধাকে পেছনে ফেলে সর্বজনগ্রাহ্য হয় কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।


আব্দুল্লাহ আল নোমান
কর-পরিদর্শক,
 নাটোর।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

হেলথ টিপস