ইদ বনাম ঈদ এবং বাঙালির ভাষাপ্রেম!
বাঙালির বাংলা ভাষাপ্রেমের মেয়াদ বছরপ্রতি এক মাস। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে ২৮ দিনের ক্ষুদ্রতম মাসটিতে বাঙালির ভাষাচেতনা জাগ্রত হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে একটা ব্যতিক্রম ঘটছে বটে।
‘ঈদ’ না কি ‘ইদ’ এই বিতর্কে ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে এক মহাসচেতনতাবোধ জাগ্রত হয়েছে। বাংলা ভাষার ইতিহাসে এ এক মহাবিপ্লব বৈকি।
বিষয়টা আমার কাছে ভালোই লাগছে। সবাই বাংলাকে নিয়ে ভাবছে, মনের কথা বলছে; খুবই ভালো কথা। এই আলোচনার সচেতনতা বারো মাস বজায় থাকুক। বিষয়টা ভালো লেগেছে বলেই লিখছি। সাধারণত সমকালীন ইস্যু নিয়ে আমার কখনোই লেখা হয় না।
আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, হওয়া উচিতও। কিন্তু এই আলোচনা-সমালোচনার মাঝে একটা সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। এমনিতে বাঙালির বাংলা ভাষায় দক্ষতা নামকাওয়াস্তে; আর বর্তমান ইস্যুতে তা আরও ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে।
‘ঈদ’ বা ‘ইদ’ বানানের পক্ষে-বিপক্ষে সমানে সবাই ফেসবুকে লিখে যাচ্ছে; কিন্তু সেই লেখাতেই বানান ভুলের মহাযজ্ঞ চোখে পড়ছে। তবে একটা কাজ অনেকেই সঠিকভাবে করতে সক্ষম হচ্ছে; আর সেটা হলো বাংলা একাডেমিকে গালি দেওয়া। বাঙালির গালির ভাণ্ডার অফুরন্ত; তার সাথে যোগ হয়ে ইংরেজি ‘এফ’ বর্ণসমৃদ্ধ একটি সরস গালি। গালি প্রদানে বাঙালির ভাষাবোধ শতভাগ ঠিক আছে; এক্ষেত্রে তাদেরকে কৃতিত্ব দেওয়াই যায়। তবে সবাই এমন তা নয়; অনেকেই গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা করছেন। তাতে যে তিনি পার পেয়ে যাচ্ছেন তা নয়; তাঁর লেখার নিচে গালিসমৃদ্ধ মহামূল্যবান মতামত দিতে ভাষা বিষয়ে হঠাৎ হয়ে যাওয়া বিশেষজ্ঞ-দল এক বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতেও নারাজ। ভাবখানা এমন বাংলা একাডেমিকে গালির স্রোতে একটা শিক্ষা তারা দিয়েই দেখাবে।
ভাষাবিজ্ঞানীদেরকেও তারা আট-দশ হাত দেখে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সব দোষ তো মাথামোটা ভাষাবিজ্ঞানীদেরই। ওরাই তো প্রাণের বাংলা ভাষাটাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ভাষা নিয়ে মাতব্বরগিরি করার অধিকারটা ওদের কে দিয়েছে?
এই হলো আলোচনা-সমালোচনার অবস্থা। আসল বিষয় নিয়ে ভাববার অবকাশ বাঙালির নেই।
তারা বলছে না বাংলা একাডেমিকে ঢেলে সাজানোর কথা। কেন বাংলা একাডেমি ভাষা পরিকল্পনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না- সে প্রশ্নও তারা তুলছে না।
আমাদের দেশে বাংলা ভাষা চরম অবহেলার শিকার। ভাষা পরিকল্পনা বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আমাদের দেশে নেই। কেউ ভাষা-বানান নিয়ে কোনো কথা বললে তাকে রীতিমতো অপমান করা হয়। অথচ প্রাণের ভাষার জন্য এই বিষয়টা অপরিহার্য। কত সমৃদ্ধ, কত সুরেলা, কত মধুর আমাদের বাংলা ভাষা। অথচ আমরা নিজের পরিচয় ভুলে পরভাষা নিয়ে মেতে আছি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা সাধারণ বাংলা শব্দের অর্থ জানে না; কিন্তু হিন্দিতে অনর্গল বাতচিত করতে পারে।
ঈদ-ইদ সমস্যা নিয়ে নিজের মতামত একটু বলি। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষা কখনও অশুদ্ধ বা খারাপ হয় না। যে বানানেই আমরা লিখি না কেন তা যদি মনের ভাব প্রকাশ করে তবে তা ঠিক আছে। তবে ভাষার একটা সৌন্দর্য আছে। ‘হলো’ শব্দের বানান এক সময় ছয় থেকে সাত প্রকারে লেখা হতো; হইল, হইলো, হল, হোল, হোলো ইত্যাদি। বিষয়টি আসলে ভাষার সৌন্দর্যকে কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করে। এ কারণেই বানানের সমতা রক্ষার জন্য প্রমিত বানানরীতির প্রয়োজন রয়েছে।
অভিধান বলছে- ‘ইদ’ বানানটি ‘ঈদ’ বানানের সঙ্গততর এবং প্রচলিত বানান। এখানে কোনো বানান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় কি? বিদেশি শব্দের বানানে ই এবং ই-কার হবে। এটা সরল একটা নিয়ম। নিয়ম অনুযায়ী ‘ইদ’ বানানটিই সঙ্গত।
অনেকে বলছেন আরবি উচ্চারণে ‘ই’ এর দীর্ঘ উচ্চারণ হয়; তাই ‘ঈদ’ বানানটি সঠিক। তাদের কাছে প্রশ্ন রইল আপনারা যখন ‘ঈদ’ বলেন তখন কি দীর্ঘ উচ্চারণ করেন? মসজিদের ইমাম সাহেবকেও বাংলায় কথা বলার সময় আমি কখনও দীর্ঘ উচ্চারণ করতে শুনিনি।
আর দীর্ঘ উচ্চারণ না হলেই কি আপনার কাছে 'ঈদ' শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে? কথা হলো বাংলায় ‘ঈ’ আছে ঠিকই; কিন্তু এর উচ্চারণ নেই। আর বিদেশি শব্দ শতভাগ উচ্চারণ অনুযায়ী লেখা সম্ভব নয়। এবার অনেকেই বলে বসবেন তাহলে ‘ঈ’ রাখার কী দরকার বাপু? কিন্তু বিষয়টা এত সহজ না যে আপনার মন চাইল আপনি ‘ঈ’ বর্ণটিকে টোকা মেরে বের করে দিলেন। এখানেই রয়েছে ভাষা পরিকল্পনার বিষয়। ‘ঈ’ বাদ দিলে আপনাকে এ যাবতকাল প্রকাশিত সব বইপত্র এবং লেখা থেকেও ‘ঈ’ এবং এর কারচিহ্ন বাদ দিতে হবে; যা কি না টোকা মারার কাজ না। বরং এজন্য আপনাকে কামান দাগতে হবে; খরচ করতে হবে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অর্থ।
যদিও ‘ইদ’ বানানটি নিয়মসিদ্ধ তারপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘ঈদ’ লেখার পক্ষপাতী। এ বানাটি আমার চোখের জন্য আরামদায়ক। প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে মনসুর মুসা স্যারের একটা কথা আমার খুব পছন্দ হয়েছে; সেটা হলো 'ঈদ' বানানটি একটা উৎসবের নাম, একটা ট্রেডমার্ক।
ইচ্ছে হলেই বানানটি পরিবর্তন করা ঠিক নয়। তাছাড়া এখন যদি জরিপ চালানো হয় তবে আমার বিশ্বাস ‘ঈদ’ এর পক্ষেই ভোট বেশি পড়বে।
ভাষার বানান কারও একার সম্পত্তি না। বানানের নিয়ম করার ক্ষেত্রে একটা ঘরোয়া মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিলে হয় না। এজন্য প্রয়োজন অসংখ্য সেমিনার আর কর্মশালার। দেশের সব ভাষাবিদ আর ভাষাবিজ্ঞানীদেরকে এক ছাদের নিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন স্তরের লোকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জরিপ চালাতে হবে। ‘ঈদ’ এর মতো অসংখ্য আরবি-ফারসি-বিদেশি শব্দের বানান নিয়ে গবেষণা করতে হবে। বানানের পাশাপাশি প্রতিবর্ণীকরণ নিয়ে কাজ করতে হবে। এভাবেই একটি দেশে ভাষা পরিকল্পনা কার্যকর হয়ে থাকে।অথচ আমাদের দেশে এসবের কিছুই নেই। কর্তাব্যক্তিরা এক্ষেত্রে বাসায় নাকে তেল দিয়ে ঘুমান, অফিসে মাছি মারেন আর মাস গেলে ব্যাংক থেকে মাসিক মাসোয়ারা নিয়ে অন্নবস্ত্রের চাহিদা পূরণ করেন। আর ফেসবুকীয় বাঙালি সম্প্রদায় বঙ্গীয় গালিবিতানের পসরা সাজিয়ে তাতে মনমতো সরস বিদেশি গালি মিশিয়ে তা তিন বেলা পরিবেশন করে। ইস্যুতে ইস্যুতে নিত্যদিন নতুন নতুন সার্কাসে বাঙালির এই অশেষ পারঙ্গমতার শেষ কোথায়!
আব্দুল্লাহ আল নোমান
কর-পরিদর্শক
নাটোর।