স্ট্রোক
পৃথিবীতে প্রতি দুই সেকেন্ডে কোথাও না কোথাও একজন মানুষ স্ট্রোকের স্বীকার হচ্ছেন। এছাড়া, প্রতি ছয় জনে একজনের কোনো না কোনো পর্যায়ে স্ট্রোকের স্বীকার হন। স্ট্রোক করলে মস্তিষ্কের নিউরনে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
মানুষের মৃত্যুর জন্য যে ক'টি কারণ দায়ী হতে পারে, তাদের মধ্যে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি! মৃত্যু না হলেও বরণ করতে হয় পঙ্গুত্ব। কেউ স্ট্রোক করলে তাকে তড়িৎ গতিতে চিকিৎসা না দেয়া হলে তার মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি প্রায় অবধারিত!
♦স্ট্রোক কী?
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে, এমনকি মস্তিষ্কের কোষেও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন। কোনো কারণে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনীর পথ সংকীর্ণ হয়ে বা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষ অক্সিজেনের অভাবে নিস্তেজ হয়ে যায়। এটাকেই চিকিৎসকরা স্ট্রোক বলেন।
♦কিভাবে বুঝবেন যে কারো স্ট্রোক হচ্ছে?
ইংরেজিতে বলা হয় স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ভাবুন ফাস্ট বা এফ.এ.এস.টি। ফাস্ট বা এফ.এ.এস.টি পরীক্ষাটি হলো সবচেয়ে সহজে স্ট্রোকের লক্ষণগুলো মনে রাখা আর চিনতে পারার উপায়। ফাস্ট পরীক্ষাটি করতে নীচের প্রশ্নগুলো করুন।
• ফেইস বা মুখ – খেয়াল করে দেখুন, মুখ কি বাঁকা হয়ে গেছে?
• আর্মস বা হাত – তারা কি দুই হাতই উপরের দিকে তুলতে পারছে?
• স্পিচ বা কথা – তার কি কথা জড়িয়ে যাচ্ছে?
• টাইম বা সময় – এই লক্ষণগুলো মিলে গেলে সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
মনে রাখবেন স্ট্রোক এর ক্ষেত্রে সময় নষ্ট না করলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এমনকি এই লক্ষণগুলো যদি খুব অল্প সময়ের জন্যেও দেখা যায় দ্রুত হাসপাতালে যান। যত দ্রুত এর চিকিৎসা করবেন ততোই রোগীর জন্য ভালো, নাহলে মস্তিষ্কে চাপের কারণে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। স্ট্রোকের দ্রুত চিকিৎসা হলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠা সম্ভব।
♦স্ট্রোকের উপসর্গ দেখলে করণীয়ঃ
মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত প্রবাহের ব্যাঘাত ঘটার কারণে ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে থাকে। সাধারণত রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে, উচ্চ রক্তচাপের কারণে বা কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ইচকেমিক স্ট্রোক হয়ে থাকে। প্রায় ৮০ ভাগ ব্রেইন স্ট্রোকই হচ্ছে ইচকেমিক (Ischaemic) স্ট্রোক। আর মস্তিষ্কের দুর্বল রক্তনালীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহের সময় রক্তনালী ফেটে গিয়ে ব্রেইন স্ট্রোক হওয়াকে হ্যামরেজিক স্ট্রোক বলে।
ব্রেইন স্ট্রোকের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।মনে রাখবেন স্ট্রোক এর ক্ষেত্রে সময় নষ্ট না করলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যত দ্রুত এর চিকিৎসা করবেন ততোই রোগীর জন্য ভালো, নাহলে মস্তিষ্কে চাপের কারণে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। স্ট্রোকের দ্রুত চিকিৎসা হলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠা সম্ভব।
♦স্ট্রোকের প্রভাবঃ
১।রোগী কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন।
২। মুখ যেকোনো দিকে বাঁকা হয়ে যেতে পারে।
৩।দুই হাত-পা বা একহাত-পা অবশ হয়ে যেতে পারে।
♦স্ট্রোকের কারণঃ
আপনার স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায় এরকম বেশ কিছু কারণ ধরতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলোর মধ্যে কিছু আপনি নিয়ন্ত্রণ করে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারেন, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনার কিছুই করার নেই।
যেসব ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই এর মধ্যে রয়েছে -
১। আপনার বয়স, বয়সের সাথে সাথে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়বেই।
২। লিঙ্গ, আপনি পুরুষ হলে আপনার ঝুঁকি বেশী।
৩। পরিবারের কারো যদি আগে স্ট্রোকের ইতিহাস থাকে।
৪। আপনার আগে যদি একটি মিনি স্ট্রোক বা ট্রানসিয়েন্ট ইশকেমিক অ্যাটাক (টিআইএ) হয়ে থাকে।
স্ট্রোকের যেসব কারণ আপনি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন -
১। শরীরে অতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে।
২। যারা দীর্ঘ সময় ধরে বসে কাজ করেন, হাঁটাচলাসহ কায়িক শ্রম করেন না, তাদের এই রোগের ঝুঁকি অন্যদের থেকে বেশি।
৩। পুষ্টিকর খাবারের পরিবর্তে ভাজাভুজি, ফাস্ট ফুড বেশি খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
৪। কোনোভাবে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে যেমন উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে।
৫। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডায়েট বা এক্সারসাইজ না করলে, স্ট্রোকের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।
৬। জন্ম নিয়ন্ত্রণ ওষুধ বা কোনো হরমোনাল ওষুধ সেবনের কারণে।
৭। নিয়মিত মাদক (হিরোইন, কোকেইন জাতীয়) সেবন করলে।
৮। রক্তে অ্যামাইনো এসিড অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে।
৯। নিয়মিত ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন করলে।
১০। স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা থাকলেও স্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে।
১১। হার্টের অসুখ থাকলে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি।
♦স্ট্রোক প্রতিরোধে করনীয়ঃ
১। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ওজন কমাতে সুষম খাবারের ওপরেই ভরসা রাখুন। ডায়েটে রাখুন পর্যাপ্ত পরিমাণে সবজি ও ফল।
২। সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধ ঘণ্টা করে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটুন।
৩। ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করুন।
৪। রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এসবের জন্য কোন ওষুধ খেলে তা চালিয়ে যান, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বাদ দেবেন না, নিয়মিত চেক আপে থাকুন।
৫। শরীরচর্চার সময় খেয়াল রাখতে হবে তা যেন অত্যাধিক পরিশ্রমসাধ্য বা ক্লান্তিকর না হয়ে ওঠে।
৬। মাদক (হিরোইন, কোকেইন জাতীয়) সেবন থেকে বিরত থাকুন।
৭। প্রতিদিন অন্তত ৬ ঘণ্টা ঘুমান।
৮।ফুরফুরে মেজাজে থাকার চেষ্টা করুন।
৯। যদি আচমকা হাত, পা বা শরীরের কোনো একটা দিক অবশ, অসাড় লাগে বা চোখে দেখতে বা কথা বলতে অসুবিধে হয় অথবা ঢোক গিলতে কষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
♦স্ট্রোক প্রতিরোধে যে খাবারগুলি অবশ্যই আপনার খাদ্য তালিকায় রাখবেনঃ
আপনার খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন এনে খুব সহজেই আপনি স্ট্রোকের মত মরণঘাতী রোগ থেকে নিজেকে ও আপনার আপনজনকে বাচাঁতে পারেন। খাদ্যগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ
১।বাদামঃ এক গবেষণা বলছে আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ১ আউন্স বাদাম রাখলে আপনার স্ট্রোকের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যাবে।
২। সবুজ শাক-সবজিঃ হাভার্ড রিসার্চ বলছে সবুজ শাক-সবজি খেলে স্ট্রোক ও হার্টের সমস্যা ২০% কমে যাবে।
৩। চকোলেটঃ চকোলেট খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়। তবে বলে রাখি সেটা ডার্ক চকোলেট হতে হবে এবং এতে কোকোয়ার পরিমান বেশি থাকতে হবে।বাজারে যে চিনি ও দুগ্ধজাত দ্রব্য মিশিত চকোলেট পাওয়া যায় তাতে স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যাবে না।
৪।সাইট্রাস ফ্রুটস: গবেষণা বলছে টক জাতীয় ফল যেমন লেবু খেলে স্ট্রোকের রিস্ক ১৯% কমে যাবে যারা খান না তাদের তুলনায়।
৫। গোটা শস্যদানাঃ আমরাতো আজকাল খোসা ছাড়িয়ে শস্যদানা খাওয়া শুরু করেছি। তবে বিজ্ঞান বলছে আপনি খোসাসহ শস্যদানা খেলে আপনার স্ট্রোকের রিস্ক কম থাকবে।
৬। রসুনঃ স্ট্রোকের রিস্ক কমাতে রসুন হতে পারে আপনার সেরা পছন্দ।
৭।টমেটোঃ টমেটোতে থাকে লাইকোপেন। এই উপাদানটা আপনার স্ট্রোকের ঝুঁকি ৫৫% কমাবে।
৮।কফি এবং গ্রীন টিঃ যারা দিনে এক কাপ কফি খায় তাদের স্ট্রোকের রিস্ক ২০% কমে এবং যারা দিনে ২ থেকে ৩ কাপ গ্রীন টি খায় তাদের ১৪% স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।
৯।পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবারঃ পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার ২১% স্ট্রোকের রিস্ক কমায়। ফল-মূল ও শাক-সব্জি পটাশিয়ামের উৎস। সবুজ শাক- সব্জি, মটরশুটি এবং মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমান পটাশিয়াম থাকে।
১০। ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারঃ পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের ভিতরে রয়েছে মটরশুটি, পাতাযুক্ত সবুজ শাক-সব্জি, গোটা শস্যদানা ইত্যাদি।
♦স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় যে সব খাবারঃ
স্ট্রোক এড়াতে হলে নিচের খাদ্যগুলি আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে কেটে দিন।
১। উচ্চ কোলেস্টরলযুক্ত খাবারঃ উচ্চ কোলেস্টরলযুক্ত খাবারের ভিতর রয়েছে ডিমের কুসুম, কলিজা, মাখন, চিংড়ি, মুরগি, ফাস্টফুড, পনির, পক্রিয়াজাত মাংশ, চিজ বার্গার, আইসক্রিম ইত্যাদি।
১। লবণযুক্ত খাবারঃ স্ট্রিটফুড বা ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার ইত্যাদিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই এসব খাবার এড়িয়ে চলবেন। রান্নার সময় খাবারে কম লবণ ব্যবহার করবেন। যাদের পাতে আলগা লবণ খাওয়ার অভ্যাস আছে তারা অভ্যাসটা পরিত্যাগ করবেন।
৩।দুগ্ধজাত খাবারঃ দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলবেন। নরমাল দুধ খাবেন না। বাজারে যে সর-তোলা দুধ বা চর্বিমুক্ত দুধ (Skim Milk)কিনতে পাওয়া যায় সেই দুধ খাবেন।
৪। মাংশঃ চর্বিযুক্ত মাংশ এড়িয়ে চলবেন। এতে স্ট্রোকের ঝুঁকি ১০% বেড়ে যায়। চামড়া বাদে চিকেন বা টার্কি খেতে পারেন।
৫। ডায়েট সোডাঃ যে ব্যাক্তি দিনে একটি ডায়েট সোডা পান করে তার স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪৮% বেড়ে যায়। তাই ডায়েট সোডা থেকে সাবধান।
শফিকুল ইসলাম
কর্মকর্তা, ডাচ্ -বাংলা ব্যাংক
লিমিটেড।
সাবেক শিক্ষার্থী, ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
কুষ্টিয়া।
Nice post
ReplyDeleteচালিয়ে যান। আমরা আপনাদের সাথে আছি।
ReplyDelete